খেলাপির দ্বারপ্রান্তে বিপুল অঙ্কের ঋণ

মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে এই ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে উদ্বেগজনক এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ব্যাংকিং খাতের নিয়মানুযায়ী কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ মাস (ঋণ ভেদে) উত্তীর্ণ হলে তখন সেই ঋণকে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময়সীমা ১২ মাস উত্তীর্ণ হলে ঋণ খেলাপির প্রথম ধাপ হিসাবে গণ্য করা হয়। উল্লেখিত প্রায় লাখ কোটি টাকা বা ৯৯ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ার বিষয়টি ঋণ খেলাপির আগের ধাপ বা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিপুল অঙ্কের এই ঋণ খেলাপি হতে বেশি সময় লাগবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত ঋণ বিতরণের পর পরিশোধের কারণে তা কমতে থাকে। কিন্তু এখানে উলটো চিত্র। মূল ঋণ তো কমছেই না, বরং অনাদায়ী হওয়ার কারণে তা ক্রমেই খেলাপির দিকে ছুটছে। যদিও এর প্রধান কারণ হিসাবে চলমান ভয়াবহ করোনা মহামারির আঘাতকে দায়ী করা হচ্ছে। অবশ্য এটি অনেকাংশে সত্যও বটে। এর ফলে কমবেশি সব খাতে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ রোববার বলেন, করোনার কারণে বেশির ভাগ শিল্প বন্ধ ছিল এবং আছে। কিছু শিল্প খোলা থাকলেও সেভাবে ব্যবসা করতে পারেনি। সে কারণে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাড়ছে। তবে ওষুধ, নিত্যপণ্যসহ কয়েকটি খাত ভালো আছে। করোনার মধ্যেও এসব খাতের চাহিদা কমেনি।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার বলেন, করোনার বাস্তবতা অস্বীকার করব না, তবে ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ এ বাস্তবতার অপব্যবহার করছেন। যাদের যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান করোনা মহামারির কারণে বিশেষ ব্যবসা পেয়েছে তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারতেন, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে সে ধরনের লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠানও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা থেকে বিরত রয়েছে। এ ছাড়া প্রণোদনার টাকাও নাকি শেয়ারবাজারে খাটাচ্ছেন এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এ খবর সত্য হলে এর চেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য এ মুহূর্তে আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, তবে যেসব স্বনামধন্য শিল্পগ্রুপ করোনা পরিস্থিতির কারণে চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাদের বিষয়ে সরকারের উচিত হবে বিশেষ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮৫ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর তিন মাসের হিসাবে এই অঙ্ক আরও বেশি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শিল্পে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বেড়েছে ২৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে শিল্প খাতে ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিতরণ কমেছে ৬৯৫ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ৪২ কোটি টাকা বা ৮০ দশমিক ২৯ শতাংশ বিতরণ হয়েছে বড় শিল্পে। মাঝারি শিল্পে বিতরণ হয়েছে ৯ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৫৪ শতাংশ, আর ক্ষুদ্র শিল্পে বিতরণ করা হয়েছে মাত্র আট হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা এসব ঋণের মধ্যে মেয়াদি ঋণের অঙ্ক ছিল ১৭ হাজার ৩৭৯ কোটি আর চলতি মূলধন খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, শিল্প ঋণে মার্চ পর্যন্ত বকেয়া পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্পের আকার অনুযায়ী বৃহৎ শিল্প, মাঝারি শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্পে বকেয়ার হার যথাক্রমে ৭৭ দশমিক ৬৯, ১৪ দশমিক ২৭ এবং ৮ দশমিক ০৪। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প ঋণে বকেয়ার অঙ্ক ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাতভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯৮, ২৭ দশমিক ০৭ ও ১ দশমিক ১১ শতাংশ বকেয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালের মার্চ শেষে মেয়াদি শিল্প ঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল দুই লাখ ৬৬ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। এক বছর পর অর্থাৎ চলতি বছরের মার্চে তা ১২ দশমিক ১২ শতাংশ বেড়ে দুই লাখ ৯৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে চলতি মূলধন ঋণে বকেয়া ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেড়ে দুই লাখ ৯৭ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।