মালেতে অভিশপ্ত রাত ফুটবলারদের

বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য রাতটা অন্যরকম হতে পারতো। নতুন এক ইতিহাস রচনা হতে পারতো মালের রাশমি ধান্দু স্টেডিয়ামে। মালের উৎসব ছড়িয়ে পড়তো বাংলার আকাশে বাতাসে। ১৬ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জায়গা করে ইতিহাসের অংশ হতে পারতেন তপু-জামালরা। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ৮০ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচের নিয়ন্ত্রণও ছিল বাংলাদেশের হাতে। কিন্তু শেষদিকে উজবেকিস্তানের রেফারির এক সিদ্ধান্তে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। নিমেষে উৎসব পরিণত হয় বিষাদে। তপু-জামালদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে মালের আকাশ বাতাস। যে কান্না গিয়ে আছড়ে পড়ে ভারত মহাসাগরে। শেষ মুহূর্তে গোল হজম করে ম্যাচ হেরে যাওয়া, পয়েন্ট হারানো ও টুর্নামেন্ট থেকে বিদায়, বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেকবার হয়েছে। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেই মালয়েশিয়া অনূর্ধ্ব ২৩ দলের বিপক্ষে শেষ মুহূতের্র গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল বাংলাদেশ। মার্চ মাসে নেপালে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালেও পারেনি জামালরা। এ রকম অসংখ্য হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী এদেশের ফুটবলারদের কাছে বুধবারের বিদায়টা একেবারে অন্যরকম। কোনোভাবেই তারা মানতে পারছেন না এই বিদায়। হোটেলে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন ফুটবলাররা। তপু, ইব্রাহিম, ফাহাদ, জিকুর আর হোটেলে মন টেকেনি। ম্যাচ শেষে কোনো খাবার মুখে তোলেননি তারা। বিষণ্ন মনে ছুটে গেছেন ভারত মহাসাগরের তীরে। টিম হোটেল থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে হুলহুলে সমুদ্র বন্দরে রাত দুইটা পর্যন্ত আনমনে বসে ছিলেন এই চার ফুটবলার। সাফের মতো আসরে এত বছর পর ফাইনাল খেলার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় সেখানে বসেই কান্না জড়িত কণ্ঠে ডিফেন্ডার তপু বর্মণ বলেন, রেফারি আমাদের স্বপ্ন খুন করেছে। ১৬ বছর ধরে আমরা এই জিনিসের অপেক্ষায় ছিলাম। রেফারি সেটা হতে দিলো না।’ তপুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন ইব্রাহিমও। ম্যাচ শেষে ড্রেসিং রুমের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে এই মিডফিল্ডার বলেন, তপু ভাই প্রথমে ভেবেছিল বিশ্বনাথের দোষে আমরা পেনাল্টি হজম করেছি। ড্রেসিং রুমে তপু ভাই বিশ্বনাথকে মারতে গিয়েছিল। আমরা তাকে আটকে রাখতে পারছিলাম না। পরে যখন ভিডিও দেখেছি তখন আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। এটা কী করে পেনাল্টি হয়? পরে তপু ভাইও বিশ্বনাথকে সরি বলেছে।’ ম্যাচের ৭৮তম মিনিটে নেপালের অর্ধ থেকে লম্বা বল ব্যাক-পাস দেন রাকিব। সেটা প্রায় ধরে নিচ্ছিল নেপালের ফরোয়ার্ড। তার আগে বক্সের বাইরে সেটি ক্লিয়ার করেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকু। ক্লিয়ার করার একপর্যায়ে বল হাতে লেগে যায় জিকুর। এই অপরাধে তাকে লাল কার্ড দেখান উজবেকিস্তানের রেফারি আকরল রিসকুলায়েভ। এটা কোনোভাবেই লাল কার্ড হতে পারে না। তবুও নিজের কার্ডকে মেনে নিয়েছিলেন জিকু। কিন্তু পেনাল্টি সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মানতে পারছেন না এই গোলরক্ষক। কাল আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে রেফারি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। মানতে পারছি না। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। এক মুহূর্ত আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এরপরেও তপু-জিকুরা যেখানে গেছেন সেখানেই তাদের ঘিরে ধরেছে প্রবাসীরা। প্রবাসীরাও নানাভাবে ফুটবলারদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কোনো কিছুই তাদের মন ভরাতে পারছে না। ঘুরে ফিরে আসছে রেফারিং প্রসঙ্গ। রেফারিং নিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে খুব কমই এমন হয়েছে যে রেফারির ‘ফিফটি-ফিফটি’ সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। কেবল জাতীয় দলই নয়, আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলেও একই ব্যাপার ঘটছে। কিছুদিন আগে মালেতেই এএফসি কাপে ভারতের এটিকে মোহনবাগানের বিপক্ষে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের ম্যাচে রেফারির বেশকিছু সিদ্ধান্ত বসুন্ধরার বিপক্ষে গেছে। নেপাল ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে সেটাই বার বার বলেছেন অস্কার ব্রুজন। নেপাল ম্যাচ কাঁদিয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত করেছে। দীর্ঘদিন পর ফুটবলে সাফল্য হাতছানি দিয়েও দূরে সরে গেছে। বাজে রেফারিং ভুগিয়েছে। এ সবকিছুর মধ্যেও আত্মসমালোচনাটাও জরুরি। মাঠের মতো মাঠের বাইরে আমাদের কর্মকর্তারা যদি একটু খেয়াল না করেন তাহলে হয়তো একই ব্যাপার ঘটতেই থাকবে বছরের পর বছর ধরে