বেক্সিমকো’র সুকুক বন্ডের লেনদেন শুরু

প্রথমবারের মতো দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের ইসলামিক শরিয়াহভিত্তিক গ্রিন সুকুক বন্ডের লেনদেন শুরু হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইস্তিসানা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গ্রিন সুকুক বন্ড। যার আকার তিন হাজার কোটি টাকা। বন্ডটি দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত ২২শে ডিসেম্বর তালিকাভুক্তির অনুমোদন পাওয়ার পর গতকাল ১৩ই জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে লেনদেন শুরু হয়। ডিএসই’র নিকুঞ্জে মাল্টি পারপাস হলে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বন্ডটির লেনদেন উদ্বোধন করেন। ডিএসই চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশেষ অতিথি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম। লেনদেন শুরুর আগে ডিএসই এবং বন্ডটির তালিকাভুক্তিকরণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ডিএসই’র পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন ডিএসই’র লিস্টিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার মো. রবিউল ইসলাম এবং বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওকে চৌধুরী। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সালমান এফ রহমান বলেন, শেয়ারবাজারের দু’টি বড় দুর্বলতা রয়েছে। এর একটি হলো কাঠামোগত। কারণ আমাদের বাজার শুধুমাত্র ইক্যুইটিভিত্তিক বাজার। এটি একটি বড় দুর্বলতা। তবে বিএসইসি’র নতুন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর সেটা পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকে ডেট সিকিউরিটিজ হিসেবে বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের লেনদেন শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে ডেট সিকিউরিটিজের মার্কেট আরও বড় হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইক্যুইটি ও ডেট মার্কেট রেশিও সমান সমান। অনেক দেশে ডেট মার্কেটের আকার ইক্যুইটির চেয়ে বেশি। তাই আমাদের দেশে ডেট মার্কেটের আকার বাড়াতে হবে। বর্তমান কমিশন বাজার উন্নয়নে বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমরা আশা করি কমিশনের এই উদ্যোগের ফলে পণ্য বৈচিত্র্যে পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারের দ্বিতীয় বড় দুর্বলতার হলো- আমাদের বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বেশি। ম্যাচিউরড বাজারে প্রাতিষ্ঠানিকদের লেনদেনের পরিমাণ বেশি হয় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কম হয়। এমনকি সেখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ফান্ডের মাধ্যমে লেনদেন করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। এ কারণে দেশের শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন হয় বেশি। ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে করপোরেট হতে হবে। এখনো আমাদের দেশে ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে ব্রোকার মনে করা হয়। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই পোর্টফোলিও ম্যানেজ করে। এটা ব্রোকারেজ হাউজগুলোর করার কথা। কিন্তু এ জন্য ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে সত্যিকারের ইনস্টিটিউট হতে হবে এবং তাদের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে সুদ হার ১৭-১৮% বেশি বলে একসময় বলতেন। এই বেশির কারণে খেলাপি ঋণ বেশি হয় বলে জানাতেন তিনি। এ কারণে তিনি সুদ হার কমানোর উদ্যোগ নেন। যার ধারাবাহিকতায় সুদ হার সর্বোচ্চ ৯% করে দেন। তিনি বলেন, এফডিআর’র সুদ হার এখন ৬ ভাগের নিচে। তবে আমাদের সুকুক বন্ড থেকে ৯% হারে দেয়া হবে। এ জন্য বন্ডটি নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু পাবলিকের কাছ থেকে সেভাবে সাড়া পাইনি। তবে প্রাতিষ্ঠানিকদের অংশগ্রহণ ভালো ছিল। পাবলিকের সাড়া না পাওয়ার পেছনে সুকুক বন্ডটির বিষয়ে ভালোভাবে তুলে ধরতে না পারার কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। অথচ এফডিআরওয়ালাদের জন্য সুকুক বন্ডটি খুবই আকর্ষণীয়। বিশেষ অতিথি অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, নতুন পণ্য বাজারে নিয়ে এসে বাজারকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে বিএসইসি। বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের মাধ্যমে সেই চেষ্টা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। এভাবেই বাজার দীর্ঘ মেয়াদের অর্থায়নের দিকে এগিয়ে যাবে। আমরা শুরু থেকেই পণ্য বৈচিত্র্যতা বৃদ্ধির কথা বলে আসছি। বেক্সিমকো সুকুকের মাধ্যমে তার যাত্রা শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বেশকিছু পণ্য আসতে যাচ্ছে। এরমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকেও সুকুক বন্ড ইস্যুর কাজ চলছে। শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রথম প্রাইভেট কোম্পানি। যারা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের লাইসেন্স পেয়েছে। তারপর থেকেই ওনাদের যোগ্য নেতৃত্বে এই কোম্পানিটিকে একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যখন কেউ এই মার্কেটকে চিনতো না তখন বেক্সিমকো গ্রুপ এই মার্কেটে এসে অনেক নতুন নতুন ইনোভেটিভ এনে আমাদের দেখিয়েছে। আজকে এই গ্রুপটিই প্রথম সাহসিকতার সঙ্গে নতুন আরেকটি প্রোডাক্ট নিয়ে এলো। ডিএসই’র চেয়ারম্যান মো. ইউনুসুর রহমান বলেন, আজকের দিনটি বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে ঐতিহাসিক দিন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডেট মার্কেটের সুকুক বন্ডের তালিকাভুক্তি হলো। এই পুঁজিবাজারকে আরও অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর আগে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আমিন ভূঁইয়া স্বাগত বক্তব্যে বলেন, বেক্সিমকো সুকুক আল ইস্তিসানা’র উদ্বোধন বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত করেছে। এই পণ্যটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডিএসই’র পরিচালক সালমা নাসরিন, এনডিসি, মুন্তাকিম আশরাফ, মো. শাকিল রিজভী, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং কোম্পানির পক্ষে ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের গ্রুপ ফাইন্যান্স এবং করপোরেট এফেয়ার্স-এর নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা জামান-উল-বাসার, তিস্তা সোলার লিমিটেড এবং করতোয়া সোলার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. রফিকুল ইসলাম, বেক্সিমকো গ্রুপের সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্সের এডভাইজর বি. কে. নাথ। উল্লেখ্য, বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইস্তিসনা হলো বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সম্পদ সমর্থিত প্রথম গ্রিন সুকুক। এটি কেবলমাত্র একটি শরিয়াহ বন্ড, যা শরিয়াহ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। বন্ডের মেয়াদকাল ৫ বছর। গ্রিন সুকুক হোল্ডারদের গ্রিন সুকুকে তাদের নিজ নিজ বিনিয়োগের ১০০% পর্যন্ত ৫ বছরের মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের সাধারণ শেয়ারে রূপান্তর করার বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। যা প্রতি বছর ২০ ভাগ হারে হয়। গ্রিন সুকুক হোল্ডাররা অর্ধবার্ষিক হারে বেইজ রেট এবং মার্জিনের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমিক বণ্টনের পরিমাণ অর্থ পাওয়ার অধিকারী হবেন। এখানে বেইস রেট ৯% এবং মার্জিন রেট বেক্সিমকো লিমিটেডের আগের বছরের এজিএম-এ ঘোষিত বেইজ রেট এবং বার্ষিক লভ্যাংশ হারের মধ্যে পার্থক্যের ১০ শতাংশ। ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লি. ও অগ্রণী ইক্যুইটি অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি.। সুকুকটির ট্রাস্টি হিসেবে কাজ করছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ। সুকুক ইস্যু আকার ৩০ হাজার কোটি টাকা, ফেসভ্যালু; ১০০ টাকা, ন্যূনতম সাবস্ক্রিপশন আকার; ৫০০০ টাকা, অরগানাইজার; বেক্সিমকো লিমিটেড, বেনিফিশিয়ারি: তিস্তা সোলার লিমিটেড, করতোয়া সোলার লিমিটেড, বেক্সিমকো লিমিটেড।