কমে যাচ্ছে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন

দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন। ৭০টি কূপের বেশিরভাগেরই উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। আগে যেখানে দৈনিক উৎপাদন হতো ১ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন হচ্ছে ৮৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। গড়ে কমেছে ২৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এই অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় দেশীয় গ্যাসের জোগান বাড়ানোর প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রয়োজন হলে ভোলার অতিরিক্ত গ্যাস কিভাবে জাতীয় গ্রিডে আনা যায় সেদিকেও চিন্তাভাবনা করা উচিত। বাপেক্সের মাধ্যমে পুরোনো কূপগুলো পুনরায় ওয়ার্কওভার তথা পুনর্খনন করেও গ্যাসের জোগান বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) একজন সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘পেট্রোবাংলা এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো উদ্যোগ নিলেই ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু বারবার উদ্যোগ নিতে বলা হলেও রহস্যজনক কারণে নেওয়া হচ্ছে না। রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপ থেকেই ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। এর জন্য সেখানে একটি আড়াই কিলোমিটার ও আরেকটি তিন কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। এই হুক-আপ লাইন করা যায়নি গত চার বছরেও। এমন আরও অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে কাজের সুযোগ আছে। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এটাই মূল সমস্যা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন গ্যাস তোলার পর কূপগুলোয় সংস্কার করতে হয়। এতে আবার আগের মতো গ্যাস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু দেশীয় খনিগুলোয় এই সংস্কার সময়মতো হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে এখন প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা (আমদানিসহ) তিন হাজার ৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে দুই হাজার ৯৯৬ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট আমদানির কথা থাকলেও হচ্ছে মাত্র ৬৮৩ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। বাপেক্সের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদন কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু তা দিয়ে পুরো সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। সংস্কার করাটা বাপেক্সের নিয়মিত কাজের মতো। তারা সব সময়ই করছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি। তিনি আরও বলেন, ‘অফশোরে (গভীর সাগর) কোনো কাজ হচ্ছে না। অনেক এলাকায় এখনও আমরা যাইনি। সেখানে যেতে যে প্রযুক্তি ও জনবল প্রয়োজন তা নেই। বাপেক্সের একার পক্ষেও এসব করা সম্ভব নয়। সমন্বিত অ্যাকশন প্ল্যান করেই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, নরসিংদী, মেঘনা মিলিয়ে ৪৪টি কূপের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫১ মিলিয়ন ঘনফুট থাকলেও এখন উৎপাদন হচ্ছে ৬৩০ মিলিয়ন ঘনফুট। সিলেট গ্যাস ফিল্ডের সিলেট, কৈলাসটিলা-১ এবং ২, রশিদপুর, বিয়ানিবাজার গ্যাসক্ষেত্রে ১১টি কূপের উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৯ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও এখন হচ্ছে ৮৭ মিলিয়ন। বাপেক্সের সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, সেমুতাং, সুন্দলপুর, শ্রিকাইল, বেগমগঞ্জ, রূপগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে সব মিলিয়ে কূপ রয়েছে ১৫টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে বাপেক্স এগুলো থেকে কিছুটা বেশি ১৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তুলছে। রূপগঞ্জ ক্ষেত্রের একটি কূপের উৎপাদন ক্ষমতা ৮ মিলিয়ন ঘনফুট হলেও এখান থেকে গ্যাস তুলছে না কোম্পানিটি। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা যদি তা করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে এলএনজি আমদানি কমানো সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণে গ্যাস উৎপাদনকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, একইসঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকেও ঝুঁকছে দেশ। এর অন্যতম কারণ হলো নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোয় অনেকাংশেই পিছিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো। দেশে মোট চাহিদার মধ্যে বাপেক্স ১০৫ মিলিয়ন, বিজিএফসিএল ৬৪০ মিলিয়ন আর সিলেট দিচ্ছে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এসব রাষ্ট্রীয় গ্যাসফিল্ড থেকে ৮১৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফিল্ডগুলো যেমন শেভরন দিচ্ছে ১ হাজার ৪১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। নিজস্ব সক্ষমতার মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারলে দৈনিক চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভর হতে হবে না। জানা গেছে, গত আড়াই দশকে বিদ্যমান গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ চলে গেছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর দখলে। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করছে ৩৭ শতাংশ। অথচ ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত শতভাগ উৎপাদন করত দেশীয় কোম্পানি। ২০০৪ সালে গ্যাস উৎপাদনে ৭৬ শতাংশ অবদান ছিল দেশীয় কোম্পানিগুলোর। তখন ২৪ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করত বিদেশি কোম্পানি। আড়াই দশকের ব্যবধানে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ২২ ফেব্রুয়ারিতে ২৩৪ কোটি ৮৫ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি দুই কোম্পানি উৎপাদন করেছে প্রায় ১৪৮ কোটি ঘনফুট, যা মোট উৎপাদনের ৬৩ শতাংশের বেশি। আর ওই দিন দেশি তিন কোম্পানি উৎপাদন করেছে ৮৫ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট, যা মোট উৎপাদনের ৩৭ শতাংশের কম। পেট্রোবাংলার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে। যেখানে উৎপাদন ক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা, সেখানে কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় শতভাগ। এর ফলে একদিকে বিদেশি কোম্পানিগুলো স্বল্পসময়ে বাড়তি উৎপাদন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিচ্ছে, অন্যদিকে গ্যাসের মজুতও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, যা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশ্বজুড়েই গবেষণা বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়। পরবর্তী আরও দুটি ধাপে উত্তোলন করলে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এরকম কোনো চেষ্টা কখনো করেনি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপে প্রায় ৬০ শতাংশ গ্যাস আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন এ গ্যাস মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে পারে। গ্যাস উৎপাদন ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়ানোর উদ্যোগ : ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ৪৬টি গ্যাস কূপ ওয়ার্কওভার তথা পুনর্খনন, অনুসন্ধান ও উন্নয়নের মাধ্যমে দৈনিক ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই কূপগুলো থেকে এখন দিনে ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে দুই হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে পেট্রোবাংলা সর্বোচ্চ তিন হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। চাহিদার বাকি ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে পূরণ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্বল্পমেয়াদি এ পরিকল্পনার আওতায় উৎপাদন বৃদ্ধি করা গেলে এলএনজি আমদানি অনেক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাপেক্স ২০টি কূপ, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ১২টি কূপ এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) ১৪টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করা হবে। নিজস্ব ২০টি কূপসহ বিজিএফসিএলের ১২টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করবে বাপেক্স। এসজিএফএলের ১৪টি কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করবে বাপেক্স এবং বাংলাদেশে তেল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়নে নিয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি শেভরন। বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী বলেন, গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে বাপেক্স নিজেদের কাজগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন গ্যাসফিল্ডের কাজগুলোও চুক্তিভিত্তিক করে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে বাপেক্সের নিজস্ব কূপের পাশাপাশি বিজিএফসিএল এবং এসজিএফএলের কূপ ওয়ার্কওভার ও ড্রিলিংয়ের কাজ করা হবে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘আমরা যদি সব পুরোনো কূপ ওয়ার্কওভার এবং ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়ন করতে পারি, তাহলে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক অতিরিক্ত প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস উত্তোলন করতে পারব। এতে এলএনজির ওপর চাপ কমবে, আমাদের যে গ্যাসের সংকট আছে সেটা অনেকাংশ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’