একরাম মাস্টারের প্রথম মাস্টারি

১৯৭৯ সাল, এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ বাড়িতে অলস সময় পার করছিআমার মেজচাচা বৈদ্যপুর হাই স্কুলের বাংলার শিক্ষক। অসুস্থতার কারনে চাচা স্কুলে যেতে পারছেন না। আমাকে ডেকে বললেন , ”বাড়িতে তো বসেই আছিস, আমাদের স্কুলে কয়েকটা দিন ক্লাস নিলে ভাল হত। বর্তমানে আমাদের স্কুলে কোন গনিতের শিক্ষক নেই। চাচার অগাধ বিশ্বাস আমি ক্লাসে অংক করাতে পারব। আমি চাচাকে বললাম, ”অংক ভাল পারলেই মাস্টারি করা যায়? মাস্টারি করার মত আমার বয়স হয়নি। আমি এখনো ছাত্র, ক্লাস নিবো কিভাবে? চাচা বললেন, ”তুই অংকের ক্লাস নিলে হেডস্যার বড়ই খুশি হবেন। আমার বিশ্বাস তুই পারবি। এই মুহুর্তে স্কুলে একজন গনিতের শিক্ষক দরকার। বিশেষ করে ক্লাস নাইন ও টেন এর উচ্চতর গনিত নেবার মত কোন শিক্ষক নেই। বললাম, ”ঠিক আছে ক্লাসে অংক করাতে পারব তবে মাস্টারি না। বেশিদিন ক্লাস নিতে পারবো না। পরীক্ষার রেজাল্ট না হওয়া পর্যন্ত নিতে পারব। এই সময় টুকুই আমাদের অনেক উপকার হবে চাচা বললেন।

বৈদ্যপুর হাইস্কুলে মাস্টরি করতে যাব, আমার অন্তরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। চাচার সাইকেলটা ভাল করে পরিস্কার করলা। গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব সোজা পথে পাঁচ-ছয় মাইল হতে পারে। সোজা পথে রাস্তা না থাকায় নয় মাইল পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হবে। সকাল সকাল নান্তা সেরে চাচার সাথে দেখা করলাম। চাচা একখানা চিঠি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ”চিঠিখানা সরাসরি হেডস্যারের হাতে দিবি। আমার পরনে লুঙ্গি গায়ে সাদা শার্ট সেই শার্টের পকেটে চিঠিখানা স্বযত্নে রেখেছিলাম। পকেটে যে চিঠি তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। পায়ে দু ফিতায়ালা পন্চের সান্ডেল। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের চেহারা বার বার পরখ করছিলাম। নিজেকে দেখে মনে হচ্ছিল মাষ্টার মহাশয় হবার সামান্যতম যোগ্যতা আমার মধ্যে নেই।

সাইকেলে চড়ে মাটির সড়ক পথে বেল বাজিয়ে চলেছি জীবনের প্রথম মাষ্টারি করতে। জীবনে চলার পথে এক অভিন্ন নতুন সমীকরন। অজানা শঙ্কা নিয়ে নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করব সে ভাবনায় মগ্ন। যে পথে চলেছি রাস্তার দু ধারে আখ খেত। জন মানব শূন্য রাস্তার মাঝ বরাবর সরু পথ যার দুধারে সবুজ ঘাস। দক্ষ চালক না হলে ঘটবে বিপত্তি কিন্তু নিশানা ঠিক রেখে একাই চলেছি সেই পথে। একবার মনে হল পথের ধারে পাকুড় গাছের তলায় বিশ্রাম নেই। শত ইচ্ছা থাকা সত্তেও সময়ের অভাবে যথা সময়ে স্কুলে পৌঁছানোর তাড়নায় গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়া সম্ভব হল না। আশ্বিনা মৃদু বতাসে আখ পাতার সড়সড় শব্দতরঙ্গ যা অন্তরে অন্যরকম ভীতির আন্দলিত অনুভব করলাম। স্কুলে পৌছে আমবাগানে গাছের গুড়ায় সাইকেলটা ঠেস দিয়ে চাবি দিলাম। স্কুলে নতুন অথিতির আগমনে অনেকেই কৌতুহলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম হেডস্যার কোথায় বসেন?

মাঝ বয়সী ভদ্রলোক মাথায় আধা-পাকা চুল চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। পকেট থেকে চাচার দেওয়া পত্র খানি হেড স্যারের হাতে দিলাম। স্যার মৃদু হেসে বললেন বসো বাবা বসো।স্যারের সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম। স্যার পিয়নকে ডেকে বললেন, ”মজিদ স্যারকে ডাকো। কালো মোটা এবং বেটে দেখতে আমার মতই তবে বয়ষ্ক হেড স্যারের রুমে প্রবেশ করলেন। হেড স্যার তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ”মজিদ সাহেব ওনাকে ক্লাসে নিয়ে পরিচয় করে দেন। আজ থেকে উনি ক্লাস নাইন ও টেন এর অংকের ক্লাস নিবেন। আরো বললেন, ”ওনাকে আই এসসির সাইন্সের শিক্ষক হিসেবে পরিচয় করে দিবেন। কথা গুলো শোনার পর কেন জানি বুকের ভিতর কাঁপা-কাঁপি শুরু হল। স্যারদের দৃষ্টির আড়ালে শার্টের বোতাম খুলে দোয়া পড়ে বুকে কয়েক বার ফু-দিলাম।

হেডস্যারের রুমে চা-বিস্কুট খেয়ে সেই মজিদ স্যারের সাথে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রথমে ক্লাস নাইনে প্রবেশ করলাম। মজিদ স্যার আমাকে পরিচয় করে দিলেন।ওনি আই এসসির সাইন্সের স্যার তোমাদের অংকের ক্লাস নিবেন। তোমরা দুষ্টুমি না করে ওনার ক্লাস মনোযোগ দিয়ে শুনবে। মজিদ স্যার আমাকে ক্লাস নিতে বলে চলে গেলেন। ক্লাসে পাঁচ-ছয় জন ছাত্রীসহ শিক্ষার্থীর সংখ্যা পঁচিশ -ছাব্বিশ জন হবে। মাটির ঘর ক্লাস রুমের জানালা একেবারেই খোলা। বাইরের আলো বাতাস সহজেই প্রবেশ করছে। রাতে দারোয়ানের অনুপস্থিতে শিয়াল বিড়ালের রাত্রি যাপন একদম সহজসাধ্য।সবার চেহারা একবার পরখ করে নিলাম। সবার চোখে-মুখে দুষ্টুমির ভাব স্পষ্ট। কেন জানি মনে হল এদেরকে নিয়ন্ত্রন করা বেশ কষ্টকর হবে। তাদের সাথে কথা বলে ডাষ্টার হাতে ব্লাকবোর্ড পরিষ্কার করলাম। হঠাৎ এক ছাত্রী বললো, ”স্যার আপনাকে কাইলা মাষ্টার বলেছে। আমি বললাম, ”বেশতো কে বলেছে? মেয়েটি আঙ্গুল দিয়ে অন্য একটি মেয়েকে দেখিয়ে দিল। আমি বললাম ওতো সত্য কথাই বলেছে তবে এ পরিবেশে বলা ঠিক হয়নি। মেয়েটি বললো স্যার ওকে বকা দিবেন না? আমি বললাম তার প্রয়োজন হবে না।

ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পালা। হেড স্যারের সাথে দেখা করে সাইকেল নেয়ার জন্য গেলাম। সাইকেলের তালা খুলতে দিয়ে দেখি সাইকেলের তালার ছিদ্র কাঠি দ্বারা বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুতেই তালার ছিদ্র থেকে বাঁশের কাঠি বের করতে পারছি না। আমার এ অবস্থা দেখে দুজন স্যার এগিয়ে আসলেন। আমাকে বললেন, ”কিছু মনে করবেন না এটা কতিপয় দুষ্টু ছেলের কাজ। দূরে দাঁড়িয়ে আমার এই অসহায়ত্বের দৃশ্য অনেকেই উপভোগ করছিল। স্যারদের সহয়তায় সাইকেলের চাবি খুলে বাড়ির পথে রওনা হলাম। সাইকেলের চাকার সাথে মনের চাকাও ঘুরছে। নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন আমার পক্ষে মাস্টারি করা সম্ভব নয়। আবার নিজেই নিজেকে শান্তনা দিচ্ছি কিছু দুষ্টু ছেলে-মেয়ে সকল প্রতিষ্ঠানেই থাকবে। সেইসব ছেলেমেয়েকে সঠিক নির্দশনায় প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তুলতে হবে। আবার এও চিন্তা করছি বাড়িতে যেয়ে চাচাকে বলব আমার দ্বারা মাষ্টারি সম্ভব নয়।

ফেরার পথে সেই পাকুড় গাছে সাইকেলটা হেলান দিয়ে তার ছায়াতলে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আখ খেত থেকে একটি আখ তুলে পানিতে পরিষ্কার করে চিবাইতে ছিলাম। মনে পড়ে অবাক পৃথিবী সিনেমার কথা। নায়ক রাজ রাজ্জাক গাছের গুড়িতে বসে আখ চিবাইতে ছিল। নায়িকা কবরী কখন তার পিছনে দাড়িয়েছে নায়ক একটুও টের পায়নি। আখের ছোবলা পিছনে ফেলছিল, যা কবরীর গায়ে পড়ছিল। মাঝে মাঝে নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে সুন্দর সুন্দর ডায়ালগ বলতেছিল। আমিও একদিন পুকুর পাড়ে মাজা ভাঙ্গা তাল গাছে ঠেসদিয়ে বসে আখ চিবাতে ছিলাম। নায়ক রাজ্জাকের মত মজার মজার ডায়ালগ গুলি আওড়াইতে ছিলাম। আমার চাচা পিছন থেকে হঠাৎ বললেন এসব কি বলছিস? তোকে কি ভুতে ধরল। কিছু বলার আগেই আমার গালে কষে এক চড়। চড় খাবার পর আমার কবরী কই যে উড়ে গেল টের পেলাম না। চাচা বললেন, ”কি -নায়ক হতে চাস, নিজের চেহারা একবার আয়নায় দেখেছিস? সেই দিনের কথা মনে করছিলাম আর আখ চিবাতে ছিলাম।

আর একবার চাচার হাতে চড় খেয়েছিলাম। গ্রামে ঘরের দেয়ালে পোস্টার লাগানো সেখানে লিখা আছে ১লা বৈশাখ বিরাট মেলা। পোষ্টারে স্থান কাল বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই শিশুকালে পোষ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চারন করে জোরে জোরে পড়ছিলাম। একলা বৈশাখ বিরাট মেলা, চাচা পাশে দাঁড়িয়ে আমার উচ্চারন শুনছিলেন। চাচা বললেন আবার পড়ত, আমি পড়ছি একলা বৈশাখ বিরাট মেলা। চাচা আমার গালে এক চড় মেরে বলছিলেন বল, ”পহেলা বৈশাখ বিরাট মেলা। সেদিন চড় খাওয়ার পর বুঝেছিলাম একলা আর পহেলার মধ্যে পার্থক্য। আজ সেই চাচাকে সন্তুষ্ট করতে ক্ষণিকের জন্য মাষ্টারির পথে।

বাড়িতে পৌছার পর,চাচার ডাক পড়ল। কি-রে স্কুলের খবর কি? হেডস্যার তোকে কি বললেন? আরো অনেক প্রশ্নআমি বললাম, ”তোমার হেড স্যার বড় অমায়িক ও নিরেট ভদ্র মানুষ। তবে তোমার স্কুলের কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী অসামাজিক এবং দুষ্টু। চাচাকে বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু বললাম তোমার স্কুলে আর যাচ্ছি না। চাচার মুখপানে চেয়ে দেখলাম বিষন্নাতার স্পষ্ট ছাপ। ভারি গলায় চাচা বললেন, ”আমি চাই তুই অবসর সময়টা আমার স্কুলে দিবি। কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইরাম। পরক্ষণে চাচার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ”দেখি ভাল লাগলে যাব তবে বেশি দিন না। চাচার অবাধ্য হতে পারিনি, যথারীতি স্কুলে গেলাম। সেই আখ খেতের মাঝে মেঠ শুরু পথ, বেল বাজিয়ে আখ পাতার সড়সড় ধ্বনি এ যেন নিত্য দিনের সঙ্গী। ছাত্র-ছাত্রীর খুনসুটি আমার নিকট ভালই লাগছিল। কয়েক দিন ক্লাস নেবার পর ছাত্র-ছাত্রীর প্রশংসা শুনলাম, নিজেকে ধন্য মনে হল।

বেশ ভালই দিন কাটছিল।প্রতিদিন সকাল সকাল সাইকেলে ছায়াঢাকা মেঠপথে নির্জনতার আড়ষ্ঠ ভেঙ্গে স্কুলে যাতায়াত শুরু হল। পথে এবং স্কুলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি উপভোগ করছিলাম। ছাত্রের ঘ্রান এখনো শরীর থেকে মুছে যায়নি তথাপি মাস্টার মাস্টার ভাব। বাড়ি থেকে স্কুলের পথ এতটাই আপন মনে হচ্ছিল যার পরিবেশ অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি এনে দিত। পথেই শুনতাম চোখগেল পাখীর ডাক। লাল ঝুটিয়ালা কাঠঠোকরা দেখা মাত্র নিজেকে গাছের আড়াল করত। আকাশ পানে জল চেয়ে চাতক পাখীর পুটিত- - জল মিষ্টি সুর আমাকে মুগ্ধ করত। মাঝে মধ্যেই পাকুড় গাছের ছায়ায় বসে মানষপটে এক ধরনের ছবি আঁকতাম। ছোট ছোট ঘটনা অন্তরে চেপে রেখে চাচার সাথে আলাপ করতাম।

আমার এইচ এস সির পরীক্ষার ফল প্রকাশ হল,চাচাকে বললাম আর তো পারিনা। এবার বিদায়ের পালা। স্কুল থেকে ছোটখাট বিদায়ের অনুষ্ঠান করা হল। দেখেছিলাম যে মেয়েটি কাইলা মাষ্টার বলে ভর্ৎসনা করেছিল তারই চোখে জল।