আরও আড়াই কোটি টাকা উদ্ধার গ্রেপ্তার ৮

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা লুটের ঘটনায় যে আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের নাম ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় প্রকাশ করেনি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কারণ ছিনতাই হওয়া পুরোপুরি টাকা এখনো উদ্ধার করা হয়নি। সন্দেহভাজন আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে ডিবি’র একাধিক টিম। তাদেরকে গ্রেপ্তার করলে বাকি টাকার হদিস পাওয়া যাবে বলে ধারণা করছে ডিবি। তাই সঠিক তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তারের স্বার্থেই ডিবি গ্রেপ্তারকৃতদের নাম প্রকাশ করছে না। তবে ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বড় অঙ্কের এই টাকা লুটের পেছনে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের থার্ড পার্টি মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের কারও যোগসাজশ থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন। 


ডিবি জানায়, মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি তাদের ১০টি গাড়িতে করে ৭টি ব্যাংকের এটিএম বুথে টাকা সরবরাহ করে। কিন্তু কোনো গাড়িতেই নিরাপত্তাকর্মী বা গানম্যান রাখে না। টাকা পরিবহনের সময় অবহিত করা হতো না কোনো থানাকেও। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগায় চকদীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করা হয় মানি প্ল্যান্টের গাড়ি। এরই ধারাবাহিকতায় ছিনতাইয়ের দিন আগাম তথ্য পেয়ে মানি প্ল্যান্টের গাড়িটি অনুসরণ করা হয়। কোন নাম্বারের গাড়িতে উত্তরা এলাকায় টাকা পাঠানো হয়েছে এটি মানি প্ল্যান্টের কেউ ছিনতাইকারীদের জানিয়েছে এবং সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে কোম্পানিটির একাধিক কর্মী জড়িত থাকতে পারে। তথ্য প্রমাণের মাধ্যমে আরও নিশ্চিত হওয়ার পর এ বিষয়ে জানানো হবে। মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক যশোদা জীবন দেবনাথ গতকাল বলেন, আমিও মনে প্রাণে চাই আমাদের প্রতিষ্ঠানের কেউ যদি জড়িত থাকে তাদের পরিচয় প্রকাশ হউক। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হউক। কারণ এই ব্যবসাটা সততার ব্যবসা।

এর আগে শনিবার ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় আট জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। গ্রেপ্তাররা হলো- মো. সানোয়ার হাসান (২৮), মো. ইমন ওরফে মিলন (৩৩), মো. আকাশ মাদবর (২৫), সাগর মাদবর (২২), মো. বদরুল আলম (৩৩), মো. মিজানুর রহমান (২০), মো. সনাই মিয়া (২৮) ও এনামুল হক বাদশা (২৬)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে ছিনতাই হওয়া টাকার মধ্যে মোট উদ্ধার হয়েছে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ টাকা। রাজধানীর মিরপুর, বনানী, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে ডিবি মিরপুর বিভাগ।

গতকাল দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকালে তুরাগ থানাধীন দিয়াবাড়ী ১১ নম্বর সড়কে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিংক প্রাইভেট লিমিটেডের গাড়ি থেকে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই উত্তরা এলাকা থেকে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রথমে রাজধানীর বনানী থেকে সানোয়ার হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার হেফাজত থেকে ১ কোটি ১৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বনানী থেকে ইমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার জোয়ার সাহারার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা। পরে উত্তরা থেকে আকাশ ও সাগর নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ১ কোটি সাত লাখ টাকাসহ ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ডিবি’র অপর একটি দল সিলেটের সুনামগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে বদরুল আলম, মিজানুর রহমান, সনাই ও এনামুল হক বাদশাকে গ্রেপ্তার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা জানায়, গত ৮ই মার্চ সিলেট যাবার কথা বলে একটি হায়েস মাইক্রো বাস ভাড়া করা হয়। ডাকাতদের কথামতো হায়েস গাড়ির চালক কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে এলে পেছনের সিট ঠিক করার কথা বলে তার হাত-পা বেঁধে রেখে গাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা। পরে তারা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রা. লি. এর গাড়ি ফলো করতে থাকে। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রা. লি.-এর টাকা বহনকারী গাড়ি অনুসরণ করে আসছিল। তারা আগে থেকে জানতো টাকা বহন করার ক্ষেত্রে মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রা. লি.-এর কোনো সিকিউরিটি ও অস্ত্র ছিল না।

তিনি বলেন মিরপুর ডিওএইচএস এলাকা থেকে ডাকাত দল ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা বহনকারী মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রা. লি.-এর গাড়ি অনুসরণ শুরু করে। একবার সামনে একবার পেছনে চলতে থাকে। এভাবে ডাকাত দলের ভাড়া করা হায়েস গাড়ি তুরাগের নির্জন স্থানে পৌঁছার পর দুই গাড়ির ধাক্কা লাগে। এই অজুহাতে গাড়ি থেকে ডাকাতদল নামে ও তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি শুরু হয়। তারা মানি প্ল্যান্ট লিঙ্ক প্রা. লি.-এর গাড়ি থেকে কয়েকজনকে নামিয়ে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দূরে চলে যায়। এরপর গাড়িতে থাকা ম্যানেজারকে ধাক্কা দিয়ে তারা টাকার ট্রাঙ্কসহ নিজেদের হায়েস গাড়ি নিয়ে ৩০০ ফিটের নির্জন এলাকার দিকে চলে যায়। হারুন বলেন, গ্রেপ্তাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে পরে তারা দুটি টাকার ট্রাঙ্ক ভেঙে দু’টি চালের বস্তা ও পাঁচটা ব্যাগে ভর্তি করে। বাকি দুই ট্রাঙ্কের টাকা দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। কোনো ব্যাগ না থাকায় টাকা ও ট্রাঙ্ক ফেলে পালিয়ে যায়। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের সিটের উপরে একটা ব্যাগ ফেলে ও নিজেরা কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে চলে যায়। অবশিষ্ট ব্যাগটি মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে থাকা ড্রাইভার সুস্থ হয়ে নিজ হেফাজতে নেয়। এ ছাড়াও সে ট্রাঙ্ক থেকে অবশিষ্ট টাকা ভরে তার ভাইয়ের হেফাজতে দেয়। পরবর্তীতে ওই চালকের বাসা থেকে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, ঘটনার দিন মানি প্ল্যান্টের কয়েকজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আটক করা হয়েছিল। প্রয়োজনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবারো ডাকা হবে। আর গ্রেপ্তারদের রিমান্ডে এনে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।