ভারতে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা: ভাগ্যবান ঝিনাইদহের কলেজশিক্ষক দম্পতি

কলকাতা হয়ে ভারতের চেন্নাইয়ের ভ্যালোরে যাচ্ছিলেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের শেখ হাসিনা সরকারি পদ্ম পুকুর ডিগ্রি কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক আক্তরুজ্জামান ও স্ত্রী নুর জাহান। দুর্ঘটনাকবলিত চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনের পেছনের বগির দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রী ছিলেন তারা। ভাগ্যবান এ দম্পতি ভারতের উড়িষ্যায় সংঘটিত ট্রেন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদশনিবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে পণ্ডিত শ্রী নামের অপর একটি ট্রেনে চড়েছেন তারা। ভারতের রেল কর্তৃপক্ষ চেন্নাইগামী ওই ট্রেনে তুলে দিয়েছেন তাদের। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় কথা হয় তাদের।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা চেন্নাইয়ের পথে রয়েছেন। ওই কলেজশিক্ষক দম্পতি চেন্নাই থেকে ভ্যালোর কাঠপট্টি স্টেশনের জন্য পরবর্তী ট্রেন ধরবেন তারা।

আক্তরুজ্জামান ভারতের ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। স্ত্রীর চোখের দ্বিতীয় দফায় অপারেশনের জন্য যাচ্ছেন ভ্যালোর এমসি হাসপাতালে।

তিনি দুর্ঘটনা ও ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, দুর্ঘটনার দিন মাগরিবের নামাজ শেষ করে উঠেছেন মাত্র। এমন সময় বিকট শব্দে কেঁপে উঠেন তারা। ধীরে ধীরে তাদের বহন করা পেছনের বগি হেলতে শুরু করে। ভয়ে আঁতকে উঠেন সবাই। কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলেন না কেও। বগি গড়িয়ে গেল অন্তত ১০ মিনিট। স্ত্রী ছিলেন নিচের সিটে। তিনি ছিলেন ওপরের বাথে। নামলেন তারা। দেখেন আগেই অনেকে নেমে পড়েছেন। চারিদিকে কান্নার আওয়াজ। শত শত মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছেন। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। কোন দিকে যাবেন বুঝে উঠছিলেন না কেউ।

ট্রেনটির পেছনের দুই বগির যাত্রীরা ভয়ে ভয়ে সমানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। অচেনা দেশ। ভাষার মিল নেই। আক্তারুজ্জামান স্ত্রীর হাত ধরে হাঁটছেন। সঙ্গে রয়েছে কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ। একটু এগোতেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে। ট্রেনের চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া বগিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। রক্তে লাল হয়ে আছে গোটা এলাকা। এলাকার মানুষের কাঁধে লাশ আর লাশ। আহতদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স।

আক্তারুজ্জামান দেখলেন সামনেই জনবসতি এবং রেল গেট। উদ্ধার কাজে যোগ দিয়েছেন হাজারও জনতা। কাছে আসতে গ্রামের মানুষেরা পথ দেখিয়ে দিলেন। শহরের নাম বলতে পারলেন না আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, কিছুদূর হেঁটে যেতেই পেয়ে গেলেন বাসস্টেশন। রাত গভীর হচ্ছে। ভুবনেশ্বরের একটি বাসে উঠলেন তারা। ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলেন ভুবনেশ্বর রেলস্টেশনে। ভোর হয়েছে। পুব আকাশে সূর্য উঠেছে।

তিনি জানান, বেঁচে যাওয়ার আনন্দ যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে আতঙ্ক। দেশে (বাংলাদেশে) চার সন্তান রেখে এসেছেন। বড় ছেলে অনিক যশোরের এমএম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মেজো মেয়ে সাইদা নাফিজা স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে আব্দুর রহমান প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ছোট মেয়ে জান্নাতুল মাওয়ার বয়স মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর।

ভুবনেশ্বর রেলস্টেশনে বসে স্ত্রী নুরজাহানের চোখের পানি বারবার মুছে দিচ্ছেন আক্তারুজ্জামান। বেঁচে যাওয়া অন্যদের একই হাল। ভাষার কারণে কারো সঙ্গে কথা বলতেও পারছেন না। শনিবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে ভারতের রেল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের কয়েকজন এলেন এবং চেন্নাইগামী যাত্রীদের বিশাল একটি ট্রেনে উঠতে বললেন। হাতেগোনা কয়েকজন যাত্রী নিয়ে পণ্ডিত শ্রী এক্সেপ্রেস ট্রেনটি ছুটতে থাকে।

দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার মানুষের মানবতার প্রশংসা করে আক্তারুজ্জামান বলেন, তারা (স্থানীয়রা) আহতদের পানি পান করিয়েছেন। জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন স্থানীয়রা। ঘটনাস্থলের কাছে জনবহুল এলাকা হওয়ার কারণে সহজেই নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পেরেছেন জীবিতরা।

পণ্ডিত শ্রী এক্সপ্রেসের আক্তারুজ্জামানের বগিতে অন্তত আটজন জীবিত বাংলাদেশি ছিলেন। আক্তারুজ্জামানের কাছেই বসেছিলেন ঢাকার এক দম্পতি। সবার গন্তব্য চেন্নাই। তাদের বহন করা ট্রেন পণ্ডিত শ্রীর অন্য বগিগুলো ফাঁকা বলে জানান তিনি।র্