শেখ হাসিনাই বারবার টার্গেটে কেন?

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালনকারী সরকারপ্রধান। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এ ব্যক্তিত্ব একটানা তিন মেয়াদসহ মোট চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পালন একই সঙ্গে তিনি উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কর্ণধার। বর্তমানে তিনি অন্যতম একজন বিশ্বনেতাও বটে।

সম্প্রতি রাজশাহী মহানগর বিএনপি নেতা আবু সাঈদ চাঁদ শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া ধৃষ্টতাপূর্ণ, শিষ্টাচারবহির্ভূত ও কুরুচিকর। হুমকিদাতার বক্তব্য যেমন নিন্দনীয়, তেমনি এরকম নেতার পৃষ্ঠপোষক দল বিএনপিও অবশ্যই বর্জনীয়। বিএনপি নেতার এ বক্তব্য থেকে এটি বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, বিএনপি অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের যে দুরভিসন্ধি করছে, তারা এক্ষেত্রে একমাত্র বাধা মনে করে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে।

যে দলটির জন্ম অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী একজন সামরিক শাসকের উর্দির পকেট থেকে, যে দলটি স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে পুনর্বাসন করেছিল, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করেছিল, সে দলের নেতার কাছ থেকে এরকম রাজনৈতিক শিষ্টাচারহীন বক্তব্য ব্যতীত ভালো কিছু আশা করা যায় না। বিএনপি অবৈধ পন্থায়, অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রে তাদের আস্থা নেই। দলটির রাজনৈতিক ইতিহাসও তাই বলে। দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে সারা দেশ এখন উত্তাল।

সাধারণ মানুষের নিন্দা আর ঘৃণা আবারও প্রমাণ করছে, বিএনপির প্রতি গণমাণুষের কোনো আস্থা নেই। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিএনপি নেতার এ ধরনের গর্হিত বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির ঘটনায় সম্প্রতি নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স প্রধান শন জে. ম্যাকিনটোশ বলেছেন, ‘মার্কিন দূতাবাস যে কোনো ধরনের উত্তেজক ভাষা, ভীতি প্রদর্শন বা সহিংসতার হুমকির নিন্দা জানাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সহিংসতা উসকে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দৃঢ়।’

বিশ্বনেতারা যখন শেখ হাসিনার যুগান্তকারী নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন, তখনই বিএনপি ও তার দোসর রাজনৈতিক দলগুলোর গাত্রদাহ শুরু হয়েছে। তাই তারা আবার নতুন করে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি নেতার এ বক্তব্য মূলত তারই বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিতে পরাস্ত হয়ে দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রলাপ বকছে দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী।

কখনো ২৭ দফা, কখনো ১০ দফা আর কখনো ১ দফার নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টার তারা লিপ্ত। এসব দফা অবৈধ, অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেশকে আবার জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করার অপকৌশল মাত্র। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে অন্ধকারে নিপতিত করাই যার চূড়ান্ত পরিণতি।

শেখ হাসিনাই কেন বারবার ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যার পর দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দেশের মানুষের আলোর দিশারী হয়ে পিতা-মাতা, ভাই, আত্মীয়-পরিজনহারা শোকে বিহ্বল বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যে ঘাতক বুলেট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ জাতির পিতাকে কেড়ে নিয়েছিল, সেই বুলেটই জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার পিছু নেয় দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই।

অন্তত ২০ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। তার ওপর প্রথম আক্রমণ হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। ওই দিন চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের খুব কাছে আট দলীয় জোটের মিছিলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পুলিশ ও বিডিআর গুলি ছোড়ে। পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট বাড়িতে থাকা অবস্থায় বুলেট-গ্রেনেড ছোড়া হয় ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে।

১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের উপনির্বাচনে ভোট দেওয়ার পর কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে রাজধানীর গ্রিন রোডে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ও বোমাবর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীদের গুলি তার গাড়িতে লাগলেও অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরদী ও নাটোর রেলস্টেশনে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে তার ওপর হামলা করা হয়। ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর রাসেল স্কয়ারে এবং ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ একই কায়দায় তার ওপর হামলা চালানো হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে।

নিজ নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ২০০০ সালের ২০ জুলাই ভয়াবহ হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন তিনি। জনসভাস্থলের অদূরে ও হ্যালিপ্যাডে ৮৪ কেজি ও ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিগোষ্ঠী হরকাতুল জিহাদ। পরের বছর ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধনস্থলে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে। ওই বছরই ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনি প্রচারে সিলেটে গেলে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভার মঞ্চের পাশেই ঘটে বোমা হামলা।

২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে তার গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। একই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা চালায়। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলিবর্ষণ করে বিএনপি-জামায়াতের ঘাতকচক্র। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশস্থলে নারকীয় ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ইতিহাস সবার জানা।

সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। যে হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী। ২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করেছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য। ২০১৪ সালের শেষদিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গিদের মাধ্যমে মানববোমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে কারওরান বাজারে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। ২০১৬ সালের জুনে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বহনকারী বিমান হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়েতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতি থাকায় নামতে গিয়ে আবার ওপরে উঠে যায়। ধারণা করা হয়েছিল, ওই বস্তুর আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেত তাকে বহনকারী বিমান। এরপর ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর সরকারি সফরে হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে বিমানের নাট ঢিল করে রাখা হয়েছিল, তাকে হত্যার পরিকল্পনায়।

সবশেষ ২০১৭ সালেও শোকের মাস আগস্টে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। বারবার বর্বরোচিত হামলা-হত্যাচেষ্টা এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ব্যূহ ভেদ করে শেখ হাসিনা তলাবিহীন ঝুড়ি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সিম্বলিক দেশ হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশকে নিয়ে এসেছেন সমৃদ্ধির পথে। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে এসব ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হবে দৃঢ়ভাবে। ইস্পাতকঠিন ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনাই বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল। দেশ ও জাতির স্বার্থে তাকে বড় বেশি প্রয়োজন। তিনি ভালো থাকলে, নিরাপদ থাকলে, বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকবে।