দেশে ডলারের তীব্র সংকট ও টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে মূলধন ঝুঁকিও। ব্যাংকগুলোয় ডলারের জোগান কমে যাওয়ায় এবং আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিপরীতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বিনিময় হারের ঝুঁকির মাত্রাও বেড়েছে। এসব খাতে আগে এত ঝুঁকি ছিল না। বরং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলারের প্রবাহ বেশি ছিল। ফলে ব্যাংকগুলোয় অতিরিক্ত তারল্যের প্রবাহ ছিল।
রোববার প্রকাশিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, শুধু বিনিময় হারের অস্বাভাবিক আচরণের কারণে ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকির মাত্রা ২৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। সার্বিকভাবে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ০১ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর মোট সম্পদের বিপরীতে ওই হারে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে।ডলার সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের দিক থেকে শীর্ষ ৫ ব্যাংক ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ ঝুঁকিতে আছে। এগুলোর কারণে পুরো বাজারে ঝুঁকি রয়েছে ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। শীর্ষ ১০ ব্যাংকের বিনিময় হারের ঝুঁকি ৬৮ শতাংশ। এগুলোর কারণে বাজারের ওপর ঝুঁকি রয়েছে ২০ শতাংশ। বাকি ব্যাংকগুলো শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলোর কারণে মার্কেটে ঝুঁকি রয়েছে সাড়ে ২৯ শতাংশ।
বিনিময় হারের চাপের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন চার্জ (ঝুঁকির বিপরীতে সংরক্ষিত মূলধনের পরিমাণ) ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোর মূলধন চার্জ বেড়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিময় হারে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোয় ডলারের চাহিদা বাড়ে। এর বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে নিুগতির কারণে ডলার আয় কমে যায়। ফলে ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক দায়দেনা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে তারল্যের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বিলের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে আবার তারল্যের জোগান দিয়েছে। ফলে ২০২২ সালে মানি মার্কেটে কোনো পদ্ধতিগত তারল্যের চাপের সম্মুখীন হয়নি। ওই বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো, স্পেশাল রেপো এবং লিকুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে তারল্যের জোগান দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ বাংলাদেশেও বেশ ভালোভাবেই এসেছে। এর প্রভাবে ঋণের সুদের হার বাড়াতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোয় ঝুঁকির মাত্রাও বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে মূলধন ঝুঁকির মাত্রা। ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতাও বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর পুঁজি ও রিজার্ভ বা সংরক্ষিত তহবিলের একটি অংশ নন পারফর্মিং সম্পদে (যে সম্পদ থেকে কোনো আয় আসে না) পরিণত হচ্ছে, যা ব্যাংকগুলোর জন্য ঝুঁকির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক স্থানীয় এবং আন্তর্দেশীয় দুই ক্ষেত্রেই সাইবার নিরাপত্তার হুমকি পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এতে লেনদেনের মাত্রা এবং যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ বাজার ২০২২ সালে একটি মাঝারি মানের স্থিতিশীলতা প্রদর্শন করেছে। যদিও বিনিময় হারের পরিমিত ওঠানামায় বাংলাদেশি টাকা যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে একটি অবমূল্যায়িত হয়েছে বছরজুড়ে। এতে রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়লেও আমদানি ব্যয়ে চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে সম্পদ, দায় এবং আনুষঙ্গিক দায়, বৈদেশিক মুদ্রার খাতে আয় আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় বাড়ায় রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে রিজার্ভ নিুমুখী হয়েছে। রিজার্ভ দিয়ে বৈশ্বিক চাপ আরও মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। কেননা এখনো বৈদেশিক মুদ্রা আয় দিয়ে চলতি ব্যয়সহ আগের দায় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে চাপের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে। ধীরে ধীরে তা আরও কমে যাবে।
এদিকে ডলারের দাম ২০২১ সালের শেষদিকের ৮৫ টাকা ২০২২ সালের শেষদিকে তা বেড়ে হয়েছে ১০৪ টাকা। এখন তা আরও বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা।
মন্তব্য