স্বল্পমেয়াদি ঋণের দায় আরও বাড়বে

১০৪৭ কোটি ডলার ঋণের মেয়াদ ছয় মাস বৃদ্ধি

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে রিজার্ভে সাময়িক চাপ কমলেও পরে তা বেড়ে যাবে। আপাতত স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ কমায় ডলারের সংকটেরও সাময়িক উপশম হবে। ব্যাংকগুলোতে ডলার নিয়ে হাহাকার কমবে। ইতোমধ্যেই ১০৪৭ কোটি ডলার ঋণের মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আগামী ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও ডলারের দাম দুই-ই বাড়বে। ফলে বেড়ে যাবে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ। ফলে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, স্বল্পমেয়াদি ঋণের দায় ছয় মাস বাড়ানোর ফলে কিছুটা সময় পাওয়া গেল। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কিছুটা গুছিয়ে নিতে পারবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ডলার, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ডলার ও বিশ্বব্যাংক থেকে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়া গেছে। এসব অর্থ ইতোমধ্যে রিজার্ভে যোগ হয়েছে। ফলে রিজার্ভ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এদিকে চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই গত মে ও জুন মাসের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১১৮ কোটি ডলারের বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ফলে রিজার্ভ আবার ২ হাজার ৯০০ কোটি বা ২৯ বিলিয়ন (১০০ কোটিতে এক বিলিয়ন) ডলারের ঘরে বা ৩০ বিলিয়নের প্রান্তসীমায় নামতে পারে। এর আগে দুই দফায় রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে।

রিজার্ভে চাপ কমাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি কমানো হয়েছে, আমদানিতে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তীব্র ডলার সংকটের মধ্যেও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। এতে ব্যাংকে ডলারের সংকট আরও বেড়েছে। এখন রপ্তানিকারক ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানিকারক ছাড়া অন্য বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছেন না। কারণ তারা চড়া দাম দিয়েও ডলার পাচ্ছেন না। ফলে রপ্তানিকারকরা নিজস্ব ডলার থেকে এলসি খুলছে। পাশাপাশি সরকারি খাত ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ( সার, জ্বালানি তেল, ওষুধ) আমদানিতে রেমিট্যান্স থেকে ডলারের জোগান দেওয়া হচ্ছে। তবে অন্য খাতের বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা এখন এলসি খুলতে পারছেন না। এতে বাজারে ওইসব পণ্যের সংকট হচ্ছে। দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত কোরবানির ঈদের সময় মসলার দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ডলার সংকটে আমদানি কম হওয়া। ডলার সংকটে দীর্ঘ সময় ধরে বাণিজ্যিক পণ্যের আমদানি কম হওয়ায় এ খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সূত্র জানায়, রপ্তানি আয়ের মধ্যে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার এখনো অপ্রত্যাবাসিত রয়ে গেছে। এগুলো দেশে আনার জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোরও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এভাবে ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের সময় আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর ফলে একদিকে ব্যাংকগুলো এখন ডলারের চাপ কিছুটা কমবে। অন্যদিকে ডলারের প্রবাহ আগামীতে আরও বাড়বে। এতে ছয় মাস পরে সুদ ও ডলারের দাম বাড়তি হলেও সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি ঋণ হচ্ছে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ২১১ কোটি ও বেসরকারি খাতে ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার। মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ স্বল্পমেয়াদি ঋণ। এই ঋণের বড় অংশই আমদানির বিপরীতে নেওয়া। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিট ৯৫৭ কোটি ডলার, আমদানির স্থগিত দেনা ৬৯ কোটি ডলার, বৈদেশিক ব্যাক টু ব্যাক এলসির দেনা ৯০ কোটি ডলার। এসব ঋণের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের কথা। এর মধ্যে বায়ার্স ক্রেডিটের ৯৫৭ কোটি ও ব্যাংক টু ব্যাংক এলসির ৯০ কোটি ডলারের ঋণসহ মোট ১ হাজার ৪৭ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে। ফলে এই ঋণের চাপ আপাতত কমবে। এসব ঋণ পরিশোধের শর্ত হচ্ছে সুদের হার ও ডলারের দাম যখন যেমন তেমন হারে পরিশোধ করতে হবে।

বৈদেশিক ঋণের সুদের হার নির্ধারিত হয় সাধারণত ছয় মাস মেয়াদি ডলার বন্ডের লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেটের (লাইবর) আলোকে। এক বছর আগে ডলারের ছয় মাস মেয়াদি বন্ডে লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার রেট (লাইবর) ছিল ২ দশমিক ১০ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ তাদের নীতি সুদের হার আরও এক দফা বাড়িয়েছে। ফলে লাইবর রেট আরও বাড়বে।

একই সঙ্গে ডলার কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। এক বছর আগে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা। ফলে ২৪ টাকা বেশি দামে ডলার কিনতে হবে। আগামী ছয় মাসে ডলারের দাম ও ঋণের সুদ হার আরও বাড়বে। এর সঙ্গে দণ্ড সুদও পরিশোধ করতে হবে। এতে ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বাড়বে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাচ্ছে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে। এর মাধ্যমে আগামীতে ডলারের প্রবাহও বাড়ানোর কাজ চলছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণের অর্থ ছাড় হওয়া শুরু করলে ও রেমিট্যান্স বাড়লে সংকট ধীরে ধীরে কমবে বলে সংস্থাটি মনে করছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) চলতি মাসের মধ্যে দেশের গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৯৯৬ কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। যা মোট আমদানি ব্যয়ের সাড়ে ৩ মাসের সমান। একই সঙ্গে ওই সময়ে নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ২০ লাখ ডলারে নেমে আসতে পারে। যা দিয়ে ২ দশমিক ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। অর্থাৎ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। চলতি অর্থবছর শেষে আগামী জুনে রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার ৪২৩ কোটি ডলারে উঠতে পারে। তখন নিট রিজার্ভ ২ হাজার ৮৭৩ কোটি লাখ ২০ ডলারে নামতে পারে। যা দিয়ে ৩ দশমিক ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। অর্থাৎ রিজার্ভ সংকট আগামী এক বছরেও কমছে না।

এদিকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, রিজার্ভে স্বস্তি ফেরাতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, রেমিট্যান্স বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ফলে সংকট কেটে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

বর্তমানে কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে দেশের মাসিক আমদানি ব্যয় ৫০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আগে মাসে ৮৫০ কোটি ডলারও ব্যয় হয়েছে। গত মে মাসে আমদানিতে খরচ হয়েছে ৪৮৪ কোটি ডলার। আমদানিতে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বর্তমান রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা অর্থ বাদ দিতে হবে। বিভিন্ন তহবিলে আগে বিনিয়োগ ছিল ৮০০ কোটি ডলার। এখন কমিয়ে ৫৫০ কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এ থেকে আরও কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আকার ৭০০ কোটি ডলার থেকে কমিয়ে ৪৬০ কোটি ডলারে নামানো হয়েছে। এটি আরও কমানো হবে।

শ্রীলংকাকে দেওয়া ঋণ বাবদ ২০ কোটি ডলার জুলাই মাসেও পাওয়া যাচ্ছে না। এটি কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। কারণ শ্রীলংকা এখনো ঋণ শোধ দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে আসেনি।

বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রপ্তানি আয় বাড়ানো। কারণ বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এখনো কাটেনি। বাংলাদেশের একক প্রধান রপ্তানির বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এটি কমতে থাকলে রপ্তানি আয়ে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানির আদেশ কমে যাচ্ছে।