আসছে অর্থনৈতিক মহাসংকট: বাংলাদেশসহ স্বল্পআয়ের দেশগুলো বেশি ঝুঁকিতে

অর্থনীতি ডেস্ক:করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব অর্থনীতি ২০০৮ সালের মন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে। এতে ৫০ কোটি লোক নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়বে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দরিদ্র লোকের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী ৩৩০ কোটি লোক বেকার হতে পারে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধির হারও কমে যাবে। এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বলছে, এতে বাংলাদেশসহ স্বল্পআয়ের দেশগুলো সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে। জাতীয় মাথাপিছু আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশগুলোকে রেমিটেন্সসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হতে পারে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও আইএলও সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ঘটবে- এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সংস্থাগুলো এখন থেকেই চারটি পদক্ষেপকে গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে চিন্তা করছি। প্রধানমন্ত্রীও এসব নিয়ে ভাবছেন। এ পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে সে কৌশল নিয়ে সবাই ভাবছেন। ইতোমধ্যে সরকার ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। তবে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে আমার ব্যক্তিগত অভিমত কৃষি খাতকে চাঙ্গা করতে হবে। এরপর অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবীদের অগ্রাধিকার তালিকায় আনতে হবে। পর্যায়ক্রমে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করে কাজ করতে হবে। কারণ আগামীতে খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর এসে পড়বে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে যেটুকু প্রবৃদ্ধি হবে এর সুফল যেন জনগণ পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে সরকারের ব্যয় বেড়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় ঠিক রেখে চলা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ জন্য বাজেটে ঘাটতি বাড়তে পারে। আগে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশ ধরা হলেও বছর শেষে এটি ৫ শতাংশের নিচে থাকত। এ বছর ৫ শতাংশ বা এর বেশি হলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না। এখন সরকারকে কর্মসৃজনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রতি বছরের মতো আগামী ১৪-১৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র করোনায় ভয়াবহ সংক্রমণের শিকার হওয়ায় বৈঠকটি ভার্চুয়ালভাবে হবে। এতে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির মন্দার ইস্যুটি বেশি গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি এর থেকে উত্তরণের বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। বৈঠক শুরুর পাঁচ দিন আগে আইএমএফ এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের জাতীয় মাথাপিছু আয় কমবে। গত তিন মাস আগেও ধারণা ছিল, মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হবে। কিন্তু এ ভাইরাস অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাতের কারণে ধারণাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আগামীতে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে। সেখানে বাংলাদেশসহ ১৭০টি দেশের ব্যাপারে একই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বর্তমান দেশের জাতীয় মাথাপিছু আয় এক হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলার। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি হবে- এমন ধারণা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্রিস্টিনা জর্জিয়েভা বলেছেন, তিন মাস আগেও বাংলাদেশসহ ১৬০টি দেশের জাতীয় মাথাপিছু আয়ে প্রবৃদ্ধি হবে, এমন ধারণা ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশসহ ১৭০টি দেশের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে, এমনটি ধারণা করছি। এর কারণ হল করোনা আমাদের সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। এদিকে, দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ ছুটির কারণে দেশব্যাপী ২৫ লাখ দোকানপাট খুলতে পারছে না। চাকা বন্ধ হয়ে আছে হাজার হাজার উৎপাদনমুখী শিল্পমিল। কয়েক লাখ হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ আছে। এরমধ্যে ৩৫টি হোটেল-রেস্টুরেন্ট হয়েছে বিভিন্ন তারকামানের। বেসরকারি অফিস-আদালত, পর্যটনকেন্দ্র ও পরিবহন বন্ধ থাকায় আগামীতে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ১ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, এ ভাইরাস দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থনীতির এ ধকল কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট হতে পারে। এ জন্য আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে আমাদেরও। গরিব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বাড়িয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আগামী ২০২১ সালের মধ্যে রিকভার করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হয়। এজন্য বর্তমান চারটি কৌশলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলোকে পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। প্রথমে স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে এ খাতে খরচ বাড়াতে হবে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যন্ত্রপাতি, নার্স-ডাক্তার এবং ক্লিনিক, মেডিকেলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতকে দ্বিতীয় গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, করোনা শ্রমবাজার, মজুরির পাশাপাশি কর খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এছাড়া নগদ অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থাকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। আইএমএফের রিপোর্টে তৃতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব দিতে এ ভাইরাসের কারণ আর্থিক খাতে ধকল কাটানোকে বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, এ ভাইরাসে ব্যাংক ও আর্থিক খাত বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি এসব খাত ঝুঁকির মধ্যেও পড়েছে। এ ধকল কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। সর্বশেষ গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়েছে, করোনার ক্ষয়-ক্ষতি উত্তরণে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এজন্য প্রয়োজনীয় স্কিম ঘোষণা, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলা হয়। আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান দেশে লকডাউন, কারফিউ, সাধারণ ছুটির কারণে কোটি কোটি মানুষ ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ভাইরাস বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে আঘাত এনেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশসহ এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার ও আফ্রিকার দেশগুলো। কারণ এসব দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও খাদ্য ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব দেশকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আইএমএফ হিসাব করে দেখছে- এ ঘাটতি পূরণের জন্য বাংলাদেশসহ স্বল্পআয়ের দেশগুলোতে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তার প্রয়োজন। কোটি মানুষকে দারিদ্র্যে নামাতে পারে : প্রায় ৯০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া নভেল করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে যেভাবে বিপর্যস্ত করছে, তাতে পৃথিবীর প্রায় ৫০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফাম। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই সতর্কবার্তা দিয়েছে নাইরোবিভিত্তিক সংস্থাটি। করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বজুড়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর আয় কমার পাশাপাশি ভোগব্যয় কতটা সংকুচিত হচ্ছে, তা হিসাব করে দারিদ্র্যের মানচিত্রে সম্ভাব্য পরিবর্তনটি আঁচ করার চেষ্টা হয়েছে সেখানে। অক্সফাম বলছে, মানুষের চোখের সামনে যে অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত বাড়ছে, তা ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতির এ সংকট কিছু দেশকে তিন দশক আগে পেছনে ফেলে আসা দারিদ্র্যসীমায় ফিরিয়ে নিতে পারে। তারা বলছেন, দৈনিক আয় যদি ২০ শতাংশ কমে যায়, সেক্ষেত্রে বিশ্বে চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে বেড়ে ৯২ কোটি ২০ লাখে দাঁড়াতে পারে। আর দারিদ্র্যসীমায় থাকা মানুষের সংখ্যা ৫৪ কোটি ৮০ লাখ থেকে বেড়ে ৪০০ কোটির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) : আইএলওর সদ্যপ্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী ৩৩০ কোটি কর্মক্ষম মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষম লোকের ৮১ শতাংশ। এরমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় ১২ কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আর মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা হবে ১০ কোটি।