আমিন ছুম্মা আমিন

মানবতার শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে প্রথম পর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা গতকাল শেষ হয়েছে। মোনাজাত চলাকালে সমগ্র ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। আমিন আমিন, আল্লাহ ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগ তীর ও আশপাশের এলাকা। ধনী-গরিব, নেতাকর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার গোষ্ঠীর মানুষ আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান আল্লাহর দরবারে নিজেকে সমর্পণ করে নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলীগ জামাতের বাংলাদেশের মুরব্বি কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. যোবায়ের আহম্মেদ। বেলা ১০টায় মোনাজাত শুরু হয়ে ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত চলে। এ মোনাজাতে দেশি-বিদেশি প্রায় ২০-২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ অংশ নেন। মোনাজাতের সময় লাখো মুসল্লি দু’হাত তুলে আমিন-আমিন করে মহান আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করেন। মোনাজাতে অংশ নিতে বাদ ফজর থেকে লাখ লাখ মুসল্লি চারদিক থেকে ইজতেমার ময়দানের দিকেযে যেভাবে পেরেছে মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। এ সময় টঙ্গী হয়ে ওঠে সকল পথের মোহনা। দোয়ায় হে আল্লাহ, হকওয়ালাদের রহমত করেন। হে আল্লাহ, যারা রোগে আক্রান্ত তাদেরকে শেফা দান করেন। হে আল্লাহ, বিশ্ব ইজতেমাকে কবুল করেন। হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করেন ইত্যাদি গভীর আকুতি-মিনতিপূর্ণ ভাষায় মোনাজাত করা হয়। আগামী শুক্রবার থেকে মাওলানা সাদ পন্থিদের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু। দ্বিতীয় পর্বের সমাপনী দোয়া অনুষ্ঠিত হবে ২২শে জানয়ারি রোববার। আবেগঘন আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করতে গিয়ে মাওলানা মো. যোবায়ের কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। কান্নার শব্দে পুরো ইজতেমা এলাকাসহ আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মোনাজাত চলাকালে দক্ষিণে বিমানবন্দর, উত্তরে গাজীপুর বোর্ডবাজার পূর্বে পূবাইলের মাঝু খান এবং পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত অন্তত প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মুঠোফোন, রেডিও এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সমপ্রচারের সুবাধে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি মোনাজাতে অংশ নেন। স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ৯৬টি দেশ থেকে ১১ হাজার ২৮৬ জন বিদেশি মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা জানায় ৬৩টি দেশের ৫,৩৮৪ জন তাবলীগ অনুসারী বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। এটি ছিল ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আখেরি মোনাজাতকে ঘিরে গোটা বাংলাদেশের নজর ছিল টঙ্গীতে। 

মোনাজাতে শরিক হওয়ার জন্য দিনটি সরকারের ঐচ্ছিক ছুটি ছিল এ এলাকায়। ২০ মিনিটের মোনাজাতে মাওলানা মো. যোবায়ের প্রথম ৫ মিনিট মূলত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ১৫ মিনিটে বাংলা ভাষায় দোয়া পরিচালনা করেন। গতকাল বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপনী দিনে স্বাগতিক বাংলাদেশ ও বিদেশি তাবল

সমাপনী বয়ান:

 মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন করেছেন সকাল সাড়ে ৭টায় মাওলানা আবদুর রহমান। পরে মোনাজাতের আগ পর্যন্ত বিশেষ বয়ান করেন মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। সমবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদেরকে সব সময় ইমান, আমল ও দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, নবী-রাসূলগণ দুনিয়াতে এসেছেন, দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু কারও কাছে কিছু চাননি। তেমনিভাবে আমরা দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে বের হবো এবং দাওয়াতে মেহনতের কাজ করবো। সে মেহনতের পুরস্কার মানুষের কাছে চাইবো না। দাওয়াতে মেহনতের পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহপাক দিবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন দাওয়াতের কাজে বের হবো তখন দোয়া করে বের হবো। প্রতিটি কাজ করার আগে দোয়া করতে হবে। তিনি বলেন, দাওয়াতের কাজে বের হলে মসজিদে ঢুকে মাসোহারা করতে হবে।

 তারপর হেকমতের সঙ্গে দাওয়াতের কাজ চালাতে হবে। তিনি আরও বলেন, মানুষকে হেদায়েত পেতে হলে মেহনত করতে হবে। মেহনত অনেক ধরনের রয়েছে যেমন: ব্যবসার মেহনত, ক্ষেত খামারের মেহনত, মাল সামানার মেহনত দ্বারা হেদায়েত পাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালাম ও সাহাবায়ে আজমাঈনগণ যে তরিকায় মেহনত করেছেন ওই তরিকায় যখন মেহনত হবে তখন আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে হেদায়েত দান করবেন। তিনি আরও বলেন, মেহনত হবে সুন্নতি তরিকায়। তিনি বলেন, আমাদের ইমানকে নতুন করতে হবে, তাজা করতে হবে। নবী করিম (স.) সাহাবায়ে কেরামের ইমান

মুসল্লিদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার: 

গতকাল টঙ্গী হয়ে উঠেছিল সকল পথের মোহনা। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ টঙ্গী অভিমুখে আসেন শুক্রবার থেকে। 

বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও কেবলমাত্র আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিগণ বাস, ট্রাক, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রেন, লঞ্চ ও ট্রলারে করে টঙ্গীতে পৌঁছে অবস্থান নিতে শুরু করে। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার লোকজন ভিড় এড়াতে আগের দিন রাতেই টঙ্গীমুখী হয়। টঙ্গী ও রাজধানী ঢাকার সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ছিল পূর্ণ ছুটির আমেজ। গত শনিবার সকাল থেকে টঙ্গীমুখী সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় দীর্ঘ পথ হেঁটে টঙ্গী পৌঁছতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। কয়েক লাখ মানুষ রাতেই ইজতেমার মাঠ, আশপাশের বাসা-বাড়ি, ভবন, ভবনের ছাদে এমনকি গাছতলায় অবস্থান নেয়। গতকাল ভোররাত থেকে যানবাহন শূন্য সড়ক-মহাসড়ক ও নদীপথে টুপি পাঞ্জাবি পরা মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার শুরু হয়। চারিদিকে যত দূর চোখ যায় মানুষ আর মানুষ। সকাল ৭টার মধ্যে গোটা এলাকা জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হয়। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এদিকে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মুনাজাতে আগের তুলনায় মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী মহিলাকে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে টঙ্গী পৌঁছে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। মোনাজাতে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ইজতেমার চারপাশে প্রায় ৩ কি.মি. এলাকা মহাসড়ক ও শাখা সড়কগুলোতে মাইক টানিয়ে দেয়। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেশের দূর-দূরান্ত ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লাখ লাখ মানুষ এসে যোগ দেওয়ায় ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে টঙ্গী, উত্তরা ও তুরাগ থানার প্রতিটি রাস্তাঘাট, বাড়ির আঙ্গিনা, ছাদ, খেলার মাঠ এমনকি গাছে চড়েও 

আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে লাখ লাখ মানুষ ফিরতে শুরু করলে সর্বত্র মহাজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গী স্টেশনে ফিরতি যাত্রীদের জন্য অপেক্ষমাণ ট্রেনগুলোতে উঠতে মানুষের জীবনবাজির লড়াই ছিল উদ্বেগজনক। ট্রেনের ভেতরে জায়গা না পেয়ে ছাদে ও দরজা-জানালায় ঝুলে শত শত মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরতে দেখা যায়। একপর্যায়ে মানুষের জন্য ট্রেন দেখা যাচ্ছিল না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, কালিগঞ্জ ও আশুলিয়া সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ফিরতি মুসল্লিদের বিড়ম্বনা ও কষ্টের সীমা ছিল না। তিন-চারদিন ধরে টঙ্গীতে জমায়েত হওয়া মুসল্লিরা মোনাজাতের পর একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরতে চাইলে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। বিকালে সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।