যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা আসতে পারে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোট ও আন্দোলনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে মূল্যায়ন করেছেন বিএনপি। ভোট বর্জনের ডাকে জনগণের সাড়াকে বড় সফলতা দেখছেন দলটি। তবে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে কিছুটা ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন তারা। সামনে নিজস্ব ছাড়াও যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে চলছে আলোচনা। সবকিছু ঠিক থাকলে সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর আগেই যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলেও সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছেআন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা বিএনপিও সুসংগঠিত হয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে কর্মসূচিও ঘোষণা করতে পারে দলটি। ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশের মাধ্যমে আবারও আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির স্থায়ী কমিটি। সমমনা দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা জানান, তারা কোনো ধরনের সহিংস আন্দোলনে যাননি। ভোট বর্জনের ডাকে জনগণ সাড়া দিয়েছে এটা তাদের বড় সফলতা। রাজনৈতিকভাবে তারা বিজয়এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বেশকিছু গণতান্ত্রিক দেশও নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে। তাদের এও পর্যবেক্ষণ, আন্দোলন কর্মসূচি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে বিএনপিসহ তাদেরও কিছু ঘাটতি ছিল। তাদের লোকবল না থাকায় বড় দল হিসাবে বিএনপির নেতাকর্মী মাঠে যতটা থাকার বিষয়ে ধারণা করা হয়েছিল, তা নামেনি। সমন্বয়ের কিছুটা অভাব ছিল। দায়িত্বশীল নেতারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। আবার এটাও ঠিক, বিএনপিকে ভাঙার বিষয়ে সরকার সব ধরনের কৌশল নিয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। সেক্ষেত্রে বিএনপি সফলতা দেখিয়েছে। 

জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে অনেকের ধারণা ছিল তাদের সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে, মাঠে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তারাও রাজধানীতে খুব সকালে ও রাতে কয়েকটি মিছিল ছাড়া অন্য কোনো জেলাতে তেমন তৎপরতা দেখাতে পারেনি। জামায়াতের তেমন কোনো শক্তি নেই নাকি তারা সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেনি তা নিয়েও তারা পর্যাভবিষ্যত আন্দোলন কর্মসূচি কেমন হবে, কী বলছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা?

লিবারেল ডেমেক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা নির্বাচিত হয়েছেন, সবাই জানেন তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হননি। ২০১৪ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন বিনা ভোটে, ২০১৮ সালে নৈশভোটে। ২০২৪ হয়েছে গোপন কামরার ভোটে। ভোটকেন্দ্রের পাশে গোপন কামরায় সিল মেরে ভোট কাস্টিং করা হয়। সত্যি চিরন্তন। সত্য সব সময় টিকে থাকবে, মিথ্যা ধ্বংস হবে। সুতরাং এই সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতাকর্মীরা, বিশেষ করে বিএনপির ২০ হাজারের ওপর নেতাকর্মী এখন জেলে। জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী জেলে। অনেকের বিরুদ্ধে ২শ থেকে ৩শ পর্যন্ত মামলা আছে। তাদের প্রতিদিন কোর্টে যেতে হয়। সেখানেও তারা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। সবকিছু পর্যালোচনা করে আমরা নেতাকর্মীদেরকে ৮-১০দিন পুনর্গঠিত করার জন্য সময় দিয়েছি। আন্দোলন ক্ষান্ত হয়নি। আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এটা কোনো নির্বাচন হয়নি। সরকার যেটাই দেখানোর চেষ্টা করুক, খুব বেশি যদি হয় ৫ থেকে ৬ শতাংশ ভোট পড়েছে। আমরা কোনো সহিংস আন্দোলন করিনি। একেবারে অহিংস আন্দোলন করেছি। মানুষকে আহ্বান করেছি ভোট দেবেন না। মানুষ আমাদের কথা শুনেছে, সরকারের কথা শোনেনি। সেদিক থেকে রাজনৈতিকভাবে আমরা জয়ী হয়েছি, পরাজিত হইনি। শুধু যুদ্ধেই জিতেছি, কিন্তু জায়গা দখল কিংবা গদিও দখল করতে পারেনি। এটা আমরা মানি। এই সীমাবদ্ধতা, এই ঘাটতিটুকু আমাদের আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মানুষ ঠিক আছে। একটা পরিবর্তনের জন্য, ভালো নির্বাচনের জন্য সব রকমের পরিবেশ আছে। অতএব, আমরা লড়াই চালাব, লড়াই চলছে।’

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জনগণ ভোট দিতে যায়নি, এটাই আন্দোলনের বড় সফলতা। যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরকারকে অন্যায্যভাবে সমর্থন করছে। তখন বড় ধরনের সংঘাত, সংঘর্ষ এবং প্রাণহানি ঘটনার সম্ভাবনা ছিল। আমরা তো জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করেছি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কর্মসূচি পালন করেছি। মানুষের জীবনের ক্ষতি হোক এটা তো আমাদের লক্ষ্য ছিল না। সেদিক থেকে মনে করি আন্দোলন সফল তিনি বলেন, ‘বাকি যেটা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের নামে যে ডাকাতি হয়েছে এটা বলা যেতে পারে, একটা যোগ্য ডাকাত বারবারই ডাকাতিতে সফল হয়। এটা নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেছে একথা বলাটা খুবই অন্যায় ও অযৌক্তিক হবে। জনগন যেহেতু এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আমরা জনগণের এই ভোটের অধিকারের লড়াই চালিয়ে যাব। সম্মিলিতভাবে সবাই মিলেই নতুন করে আবার আন্দোল-সংগ্রাম শুরু করব।’

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলপিডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন সফল। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় বসে গেছে এই মুহূর্তে তাদের মনোবল কিছুটা তুঙ্গে। আমরা কিছুটা হতাশ এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমরা চাই যে, নেতাকর্মীরা যারা জেলে আছে তাদের বের করে সুসংগঠিত হয়ে আবারও আন্দোলন করব। এখনকার তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নেতাকর্মীরাও জানে, স্বৈরাচার হটানো অনেক কঠিন ব্যাপার। কিন্তু কোনো স্বৈরাচারই ক্ষমতায় টিকতে পারেনি। এ ধরনের জনবিচ্ছিন্ন সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না তা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

ভোট বর্জন করা এসব দলের আরও পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সার্বিক বিষয়ে আন্দোলন বিফলে তা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ ভোট প্রতিহত করার কোনো কর্মসূচি তারা দেননি। তারা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন, জনগণ তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। সামনে আবারও মাঠে নামবেন। দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক সব কর্মসূচি পালন করবেন। পাশাপাশি বিদেশিদের চাপও থাকবে। সবকিছু মিলিয়ে সরকার ক্ষমতায় টিতে থাকতে পারবে না বলে তারা বিশ্বাস করেন। তাদের পর্যবেক্ষণ, আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যতটুকু জনপ্রিয়তা ছিল, ভোটের পর এখন তা আরও কমেছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেরা নিজেরা নির্বাচন করে এখন মারামারিও করছে। তৃণমূল পর্যায়ে তাদের নিজেদের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন ছিল তাও এখন অনেকটা নেই। বিএনপিসহ মিত্রদের আন্দোলন সফল হয়নি-এমন ভাবাটা ঠিক নয়। বরং এ রকম ভোট করে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন, ‘পুলিশ, বিডিআর, আমলা সবাই মিলে চেষ্টা করে ১০ শতাংশের বেশি মানুষকে কেন্দ্রে হাজির করতে পারেনি। যদি মনে করি এরাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাহলে এটা প্রামাণিত যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থন এখন ১০ শতাংশ বা এর কাছাকাছি। জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে আওয়ামী লীগ এখন দেশের তিন নম্বর রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।’

শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাননি-এটা ধ্রুব সত্য। পরে এটাকে ম্যানুপুলেট করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন সারা বিশ্বে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরা মারামারি করছে। এতে করে আওয়ামী লীগই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতোমধ্যে তারা রাজনৈতিকভাবে একেবারে দেউলিয়া ও বন্ধুশূন্য হয়ে পড়েছে।’