ছোট গল্প 'ফকিরনি' নিখিল:: রায় পূজন


 রিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বয়স আজ তিন বছর, কত দ্রুত না দিন চলে যায়। ওর ভর্তি পরীক্ষার রিজাল্ট যেদিন বের হয়েছিল সেদিন বাবার আনন্দ দেখে কে। ছোট্ট গ্রামের প্রায় সবাই রিনাকে অভিনন্দন জানাতে ছোটে এসেছিল ও দের বাড়ীতে।বাবা হাসি মুখে সবাইকে মিষ্টি মুখ করিয়ে মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চােয়ে বললেন ও যেন লেখা পড়া শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।।রিনা বাবার স্বপ্ন পূরণে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, লেখাপড়ায় একবিন্দু ও ছাড় দেয়নি, সারাদিন ক্লাস অথবা লাইব্রেরী তে ব্যস্ত সময় পার করে। এত পরিশ্রমের ফল ও হাতে হাতে পেয়েছে। এ পর্যন্ত সব পরীক্ষায় খুব ভালো ফলাফল করেছে। মজার ব্যাপার হলো এই লাইব্রেরীতে রাশেদের সাথে পরিচয়। রাশেদ ওর এক বছরের সিনিয়র। ক্লাস না থাকলে রাশেদও লাইব্রেরীতে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।প্রথমে সামান্য কথাবার্তা হতো সেখান থেকে একসময় ভালোলাগা ভালোবাসা হয়ে যায়। পড়ালেখার অবসরে প্রায়ই দুজন ঘুরে বেড়ায়। রিনা এক সময় রাশেদকে ওর গ্রামের কথা, বাবা, মা ও ছোট ভাই বোনদের কথা বলে৷ রাশেদ কখনও গ্রামে যায়নি ওর খুব ইচ্ছে হয় গ্রামে যেতে। রিনাকে বললো, আগামীতে ভার্সিটির বন্ধ হলে তোমাদের গ্রামের বাড়িতে যাবো। রিনা খুব খুশি হয় । রাশেদ বলে তোমার মতো আমার কোন গল্প নেই। ঢাকায় জন্ম, বাবা ব্যবসায়ী মা গৃহিণী আমি একা আমার কোন ভাই বোন নেই। দিন গুলি ভালোই কাটছিলো। একদিন রাশেদ বললো মা বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চান আগামীকাল বিকেলে আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো। রিনা রাজী হয়। রাশেদের ড্রইংরুমে বসে ঘামছে রিনা । রাশেদের মা বাবার কথার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। ভাবতে পারেনি, এখানে এত নির্মম নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হবে। রাশেদের মা,আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের সামাজিক অবস্থান, বংশ মর্যাদা কোন কিছু ভাবলে না,তোমার বাবা দু ' টাকার স্কুল শিক্ষক। আর রাশেদের বাবা বাংলাদেশের এতবড় একজন শিল্পপতি। তুমি ফকির স্কুল মাস্টারের মেয়ে ফকিরনি। রিনার সারা শরীর জ্বলে উঠলো। নিজে প্রেম করতে গিয়ে বাবা মাকে অপমান, কি দরকার এমন প্রেমের! অনেকে তো নানা কারণে নিজের জীবনের প্রথম প্রেম বিসর্জন দেয়। আমি ও নায় তাই করলাম। জানি রাশেদ কষ্ট পাবে ভীষণ কষ্ট। তবুও তো ওর অহংকারী মা বাবার আদর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে না। রিনা তৎক্ষণাৎ ওর প্রেমের সলিল সমাধির সিদ্ধান্ত নেয়। রাশেদের মা বললেন তোমার সাথে রাশেদের বিয়ে হওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না।তুমি রাশেদের জীবন থেকে সরে যাবে। রাশেদ কে কিভাবে ম্যানেজ করবে তুমি জান। বুঝতে পেরেছো? রিন বললো,জ্বী বুঝতে পেরেছি । কোন সিন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবে না।রিনা "চৌধুরী ভিলা " থেকে বেরিয়ে আসে , রাশেদ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । রাশেদ বললো,আমার মা বাবাকে কেমন দেখলে? খুব ভালো। আমাকে অনেক আদর যত্ন করেছেন। সমস্যা হচ্ছে তুমি যে এত বড় লোক। সেটা আগে বলোনি কেন?আমি আসলে তোমাদের সাথে এডজাস্ট করতে পারবো না। তুমি আমাকে ভুলে যাবে! কি বলছো এসব? যা বলছি আশাকরি শুনতে পেয়েছো। এরপর রাশেদ অনেক চেষ্টা করেও রিনার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারেনি। পাঁচ বছর পরের কথা। করোনা মহামারী চলছে। রিনা ঢাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। হঠাৎ থানা থেকে ফোন, "ম্যাডাম ভোর বেলা চারজন লোক কে আফাজ চৌধুরীর গেইট থেকে ধরে আনা হয়েছে, ওরা চৌধুরী ভিলায় ঢুকবার চেষ্টা করছিল,আমরা ভেবেছিলাম চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল। কিন্তু জেলের ভয়ে ওরা নিজ থেকে যা বললো, তাতে আমরা অবাক হয়ে যাই। তাদের কথার সারাংশ হচ্ছে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে নাকি নকল একটি প্রসাধনীর কারখানা আছে,ভোরের শিফটে ওরা কাজ করে তাই প্রতিদিন ভোরবেলা ঐ বাড়িতে কাজে যায়।" রিনা বললো, "পুলিশ ফোর্স রেডি করো, ঐ বাড়িতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করবো।" রিনা দ্রুত হাত মুখ ধোঁয়ে বেরিয়ে পরে। মনে মনে বলে চৌধুরী সাহেব প্রস্তুত হন আমি আসছি। সত্যি সত্যি চৌধুরী ভিলায় নকল প্রসাধনীর কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। নকল প্রসাধনী তৈরী ও বাজারজাত করার কারণে ভাম্যমান আদালত আফাজ চৌধুরী কে বিশ লক্ষ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল প্রদান করে। আফাজ চৌধুরীর হাতে হাতকড়া লাগানো হলো। বারান্দার রাশেদের মা,রাশেদ ও বছর দু-একের বাচ্চা নিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সম্ভবত রাশেদের স্ত্রী হবে । রিনা রাশেদের মায়ের কাছে গিয়ে বললো," ফকির স্কুল মাস্টারের মেয়ে ফকিরনি কে চিনতে পেরেছেন তো"?রাশেদের মা হতভম্ব হয়ে রিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে যেন ভুলে গেছেন। রিনা আর কোন কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে ওর গাড়িতে গিয়ে উঠলো।