পার্বতীপুরের হকার মাঈন উদ্দিন

একরামুল হক (সাবেক শিক্ষক, বিকেএসপি)


মাঈন উদ্দিনের বাবা ছিল সেকালে আমাদের এলাকায় নামকরা কবিরাজ। শুনেছি আমাদের গ্রামে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস করত। কবিরাজ বাবার ইচ্ছা আদরের একমাত্র পুত্রকে ডাক্তার বানাইবেন। মাঈন উদ্দিন তার বাবার মনের বাসনা পূরণে ব্যর্থ হন। কবিরাজ বা ডাক্তার না হতে পারলেও হয়েছে হকার। বাবার মৃত্যুর পর ছন্নছড়া জীবন যাপন। শহর গঞ্জে ওস্তাদ হকারের তালিম নিয়ে সে হকার জীবন বেছে নিল। বৃদ্ধ মাতা মাঠে-ঘাটে লাকড়ি গরুর গবর কুড়িয়ে কোনমতে দিনাতিপাত করছিল। মা'র কথা মনে হলে মাঝে মধ্যে গ্রামে আসত, সঙ্গে তার মার জন্য যতসামান্য কিছু সদাই পাতি। ছেলের আগমনে অভাগী মার আনন্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ত। মার বায়না  আর গ্রাম ছাড়িস না বা! গ্রাম থেকেই আশে পাশের হাট বাজারে হকারী করলে অসুবিধা কোথায়? বাবারে আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।যা দু পয়সা আয় হত তা আমাদের মত গরীবের বেঁচে থাকা যথেস্ট। তবে একটা কথা মনে রাখবি তুই আমার কাছে থাকলে আমি শান্তিতে মরতে পারতাম। 

বৃদ্ধ মাতার কথাই বেশ কয়েক মাস গ্রামেই অবস্থান করল। মা'র ইচ্ছা তাকে বিয়ে দিবে তবে মাইন উদ্দিন তার মাকে সান্তনা দিয়ে বলল, "মা এখন বিয়ে করার মত পরিস্থিতি হয়নি। আয় রোজগার তেমন হচ্ছে না, এ অবস্থায় বিয়ে করে বউকে খাওয়াব কি? মা ছেলেকে সান্তনা দিয়ে বলছিল, "সে চিন্তা তোকে করতে হবে না। আল্লাহ সহায় হলে দু বেলা দু মুঠো ভাতের যোগাড় এমনিতেই হয়ে যাবে। মাঈন উদ্দিনের ইচ্ছা নেই নিজ এলাকায় হকারী করার। মাঈন উদ্দিনের মা তার সামান্য জোমানো কিছু টাকা পুত্রের হাতে তুলে দিল। মা বলল,"বাড়ি থেকেই কিছু একটা কর বাবা। মা'র অনুরোধে এলাকার হাট-বাজারে দাঁতের মাজন বিক্রি করতে লাগল। এই দাঁতের মাজন তৈরিতে সে ব্যবহার করত বয়লারের ছাই। ছাইয়ে কিছু সুগন্ধি কেমিক্যাল মিশিয়ে হাট-বাজারে বিক্রি করত। 

প্রতি রবিবার গ্রামের পাশেই চান্দাশের হাট। দুর-দুরান্ত থেকে লোকজনের সমাগম হত। হাটে কৃষক কুমার কামার,তাঁতী নাপিত মুচি সবজীয়ালা আরো হরেক রকম লোকের ভিড়ে জমজমাট। দুর হতে কান পেতে শোনা যেত হাটের সোরগোল। হকার প্রথম প্রথম লোক জমানোর জন্য ডুগডুগি বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করত। ম্যাজিকে তেমন পক্ত না হওয়ায় খেলা দেখাতে গিয়ে ধরা খেল। রুমালের মধ্যে লুকানো টাকা উধাও করতে গিয়ে টাকাটা মাটিতে পড়ে যায়। হাত সাফাই তেমন পক্ত না হওয়ায় লোক সমাবেশে লজ্জায় পড়ে। স্বপ্ন দেখে একদিন অনেক ধনী হবে গ্রামের সরদার বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে সুখের ঘর বাঁধবে। মাকে কষ্ট করে পরের বাড়িতে খাটতে হবে না,আরো অনেক। তবে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় ,বাস্তব বড়ই কঠিন। 

শুরু হল মাঈন উদ্দিন হকারের মজাদার কথার মালা। ম্যাজিকে ব্যর্থ তবে তার কথা শুনে উপস্থিত লোকজন বেশ মুগ্ধ। ঔষধ কি আর কাজ করবে তার কথার ফুলঝুড়িতে অনেকের অসুখ এমনিতেই অর্ধেক সেরে যেত। ছোট্ট শিশিতে এক ধরনের তৈল যে তৈল এমন কোন অসুখ নেই যা ভাল না করে। আছেন কোন বয়রা যে জন্মের পর থেকেই কানে কম শুনেন। শিশুকালে গোসলে কানে পানি প্রবেশ করায় তা বের না হয়ে কানের ভিতর শুকনো জমাট বেধেছে। শুধু এক ফোটা ঔষধ কানে দিব মুহুর্তেই কান পরিস্কার এবং পূর্বের নায় আবার স্পষ্ট শুনতে পারবেন। জায়গায় বসে আওয়াজ দিবেন আমি এখনই এর প্রমান আপনাদেরকে দেখাব। হকারের কথা শুনে উপস্থিত পাবলিক একজন আর একজনের মুখপানে চাওয়া-চাওয়ি করছিল ।

হঠাৎ একজন সহজ সরল লোক হাত তুলে চিৎকার করে বলল, "ভাই আমি কানে কম শুনি। হকার মাঈন উদ্দিন লোকটির কান ভাল করে পরিক্ষা করল। টর্চের আলোতে দেখে বললো বহু পুরোনো রোগ কানের ভিতর পানি জমে পাথর হয়ে গেছে। আমার এই এক ফোটা ঔষধ কানে দেয়া মাত্র বুদ-বুদ উঠতে শুর করবে। তবে ভয়ের কিছু নেই মুহুর্তেই কান পরিস্কার হয়ে যাবে। লোকটিকে ঘাসের উপর শোয়ানো হল,কানে দু ফোটা ঔষধ দেয়া মাত্রই লোকটি চিৎকার শুরু করল। অনেকেই বলাবলি করছে,ঔষধের এ্যাকশান শুরু  হয়েছে।লোকটি একটু পরে মাটি থেকে ঘাড় কাত করে উঠে দাঁড়ালো। হকার মাঈন উদ্দিন তার কানের কাছে গিয়ে একটু উচ স্বরে বলল, "এখন কেমন লাগছে? লোকটি বলল ভাল তবে আগে যা শুনতাম এখন তাও শুনি না। হকার সান্তনা দিয়ে বলল, "একটু বিশ্রাম নেন সব ঠীক হয়ে যাবে। আসলে হয়নি তবে গ্রামের সহজ সরল লোকটি চিরদিনের জন্য বয়রা হয়ে গেল। 

হকার মাঈন উদ্দিনের অন্তরে ছিল গভীর প্রেম-ভালবাসা। গ্রামের সরদার বাড়ির এক মেয়েকে ভালবাসত সেটা ছিল একতরফা। সরদার বাড়ির খোলায় সাপুড়ে সাপ খেলা দেখাচ্ছিল। সেই বাড়ির বউ-বেটিরা দরজায় দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে সাপ খেলা দেখছিল। হকার মাঈনের স্বপ্নের রানী সহ আমরা গ্রামবাসীরা অনেকেই সেই খেলা উপভোগ করছিলাম। মাঈন উদ্দিনের এক বন্ধু তার কানে-কানে কি যেন বলল। হকার তার সাগরেদকে সংগে করে তার ম্যাজিক দেখানোর সারমন্জম নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল। সাপুড়েকে সে বলছিল ব্যাটা তুমি খেলা জমাইতে পারনি এবার আমার খেলা দেখ।আমরা ছোটরা চারিদিকে গোল হয়ে বসে হাত-তালি দেয়া শুরু করলাম। হকার যাকে মুগ্ধ করাতে চেয়েছিল সে কতখানি মুগ্ধ হয়েছিল বলতে পারব না তবে আমরা গ্রামবাসীরা সবাই তার ম্যাজিক খেলায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। 

একদিন সন্ধ্যাবেলা গ্রামের তাল পুকুর পাড়ে বেশ কিছু লোকের সমাগম। সেই গল্পের আড্ডায় হকার মাঈন উদ্দিনও উপস্থিত ছিল।সেখানে বালুবাজার থেকে আগত আমার ময়েন দাদার ভাল চোখ কিভাবে চিরতরে নস্ট হল সে কাহিনী  সবার সামনে বলছিল। ধান বোঝাই ট্রাকের উপরে বসে ধান বেঁচার জন্য রাজশাহী শহরে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আম পাতার ঘষা লাগে তার চোখে। পাতার ঘষায় তার চোখ বেশ লাল হয়ে যায়। বাড়ি ফেরার পর গ্রামে কোন ডাক্তার না থাকায় সে গ্রামের হকারের স্মরণাপূর্ন হন। সেই হকারের ভাষ্যমতে তার কাছে যে ঔষধ আছে তা দু-এক ফোটা দিলেই ইনশাআল্লাহ ভাল হয়ে যাবে। ঔষধ দেবার পর তার চোখ এতটায় জ্বালা-পোড়া করতে লেগেছে দু চারজন লোক তাকে কুরবানীর গরুর মত মাটিতে ঠেসে ধরে রেখেছে। আয়ান দাদার চিৎকার চেচামেচি দেখে হকার বলছে এবার ঔষধের এ্যাকশান শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর আয়ান দাদার চোখের মনি পুরোটায় সাদা হয়ে যায়। যার পরিনতি একেবারেই অন্ধ। 

গল্প শোনার পর হকার মাঈন উদ্দিন বলছিল ঐ বেটাকে জেলে দেয়া উচিৎ ছিল।তৎক্ষনাত উপস্থিত একজন বলে উঠল,"তুমি গ্রামে কি করেছিলে মনে নেই? তোমারও বিচার হওয়া উচিৎ। হত দরিদ্র জিয়ার বুড়ার বাড়িতে ছোট বড় সবার চোখ উঠল। তুমি কি করলে মাথা ব্যাথার জামব্যাক মলম সবার চোখে লাগিয়ে দিলে। পরের দিন সবার চোখের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম মনে হয় সবাইকে  ভিমরুলে কামড়িয়েছে। চোখ এমন ভাবে ফুলে উঠেছে কেউ চোখের পাতা মেলাতে পারছিল না। তোমার পরামর্শেই তো গরীব জিয়ার বুড়ার বাড়ির সবার চোখ নস্ট হবার উপক্রম হয়েছিল। আসলে সব হকারই ভাবখানা এমন তাদের তৈরী ঔষধ সর্ব রোগের মহৌঔষধ। সেদিন হকার মাঈন উদ্দিন মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছিল। 

এলাকার মানুষের লাঞ্চনা-বঞ্চনা সহ্য করে গ্রামেই মা'কে নিয়ে সুখেদুখে দিন চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মা'র মৃত্য হলে গ্রাম ছেড়ে একেবারেই নিরুদ্দেশ। বহুদিন পর জানা গেল তার বাবার জন্ম ভিটায় ছোট্ট বসত গড়েছে। পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন এর পাশেই তার স্থায়ী বসবাস শুরু হল। সরদার বাড়ির মেয়ের কথা ভুলে সেই এলাকায় গরীব ঘরের এক মেয়েকে জীবন সঙ্গী হিসেবে বেচে নিল। প্রতিদিন রেলগাড়িতে উঠে যাত্রীদের মনোরঞ্জন মার্কা বক্তৃতা দিয়ে নিজের তৈরী মলম বিক্রি করত। যাত্রা পথে এলাকার পরিচিত মুখ দেখলে তার কাছেই গ্রামের খবর নিত। অভাবের তাড়নায় একদিন গ্রামে এসেছিল,সেটা তার মার থাকার ছোট্ট মাটির ঘরটি বিক্রি করতে। যেটুকু মায়া ছিল গ্রামের প্রতি তাও আর থাকলো না। জীবিকার তাগিতে শিকড়ের বন্ধন ছিন্ন করে একে বারেই গ্রাম ছাড়া ।আমার জানা মতে তার স্ত্রী পুত্র কন্যা তারা কখনো এ গ্রামে আসে নাই। মৃত্যুর পর হকার মাঈন উদ্দিন স্থায়ী ভাবেই এসেছে। এ গ্রামেই চির-নিদ্রায় শায়িত আছে বকুল তলার নীচে।